গ্রামেগঞ্জে ছাত্রবন্ধু, অলোকের Yellow Bag
নিভু নিভু কুপি অথবা কেরোসিনের হারিক্যান, পাতা মাদুরে দুলে দুলে পড়াশোনা। আজও গ্রামের দিকে এই ছবি বিরল নয়। ঠিক এইরকমই পরিবেশে বড় হয়েছেন উত্তর বিহারের প্রত্যন্ত এক গ্রামের যুবক অলোক কুমার। তখনই মনে হত, পড়ার জন্য একটা টেবিল হলে বড় ভালো হয়। স্বল্প আলোতে ঘাড়গুঁজে পড়তে কষ্ট হতো। বড় হয়েও সেই দিনগুলির কথা মনে রেখেছেন অলোক। তাই ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রথম যে কাজটি করেছেন সেটি হল একটা অভিনব ব্যাগ তৈরির পরিকল্পনা। অলোক এই ম্যাজিক ব্যাগের নাম রেখেছেন ‘ইয়েলো ব্যাগ’।
এই ব্যাগের অভিনবত্ব হল এর সিঙ্গল ফোল্ড টেকনিক। ব্যাগটিকে ভাঁজ করে একটি ডেস্কের মতো ব্যবহার করা যায়। একবার ভাঁজ করলেই সেটি ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রির কৌণিক আকার নেবে। তার উপর বই বা খাতা রেখে পড়তে বা লিখতে কোনও অসুবিধা হয় না। পড়া বা লেখা না হয় হলো, কিন্তু গ্রামের দিকে বিদ্যুতের যা অবস্থা তাতে রাতে আলো কই! এই সমস্যারও সমাধান রয়েছে ম্যাজিক হলুদ বাক্সে। ব্যাগটির সঙ্গেই লাগানো রয়েছে একটি সোলার এলইডি ল্যাম্প। রিচার্জএবল ব্যাটারি সমেত একটি সোলার কিটও থাকে সঙ্গে। সৌরশক্তির মাধ্যমে চার্জ করার পাশাপাশি প্লাগ পয়েন্ট দিয়ে বিদ্যুতের মাধ্যমেও ব্যাটারি চার্জ করা যায়। ব্যাটারিটির টানা আট ঘণ্টা চলার ক্ষমতা রয়েছে।
বছর চব্বিশের অলোক কুমারের জন্ম উত্তর বিহারের সীতামারি গ্রামে। শৈশবে গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা। আজ একজন কৃতি উদ্যোগপতি। কিন্তু গ্রামের স্মৃতি ভোলেননি। আদতে, সেই স্মৃতিই তাঁর উদ্ভাবনী শক্তির ধারক ও বাহক। ‘গ্রামের গরিব বাচ্চাদের স্কুলে বই বয়ে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট চোখের সামনে ভাসে। বেশিরভাগের ব্যাগও থাকত না। বাড়ি থেকে স্কুলের দীর্ঘ পথ, সেটা পেরিয়ে স্কুলে গিয়েও নিস্তার নেই। লেখাপড়ার জন্য ডেস্ক তো দূর ভাঙা বেঞ্চও মিলত না’, স্মৃতি হাতড়ে বলেন তরুণ উদ্যোক্তা।
ডিজাইনের প্রতি আগ্রহ এবং নিত্য নতুন উদ্ভাবনের প্রতি টানে ২০০৮ সালে পুনের সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনে পড়তে যান অলোক। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং প্রডাক্ট ডিজাইনে স্নাতক স্তরে পড়ার সময়ই গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারত ঘুরে ফেলেন। চাকরি পান রাজস্থানের উদয়পুরে পাইরোটেক ওয়ার্কস্পেস নামে একটি সংস্থায়। অফিসের আসবাব ও কন্ট্রোল রুম তৈরি করাই ছিল ওই সংস্থার কাজ। সেখানেই সহকর্মী মণীশ মাথুরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কিছু করে দেখানোর তাগিদে দুজনেই চাকরি ছাড়েন ২০১৩-য়। ২০১৪ সালে তৈরি করেন নিজেদের সংস্থা প্রয়াস ইনোভেশন। সংস্থার সহ প্রতিষ্ঠাতা ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মণীশ ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর। অলোক চিফ অপারেটিং অফিসার।
পড়াশোনা, ভালো চাকরি সবকিছুর পরও গ্রামের সেই পুরনো স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াতো অলোককে। কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় ভাবতে থাকেন কুমার। ভাবতে ভাবতেই মনে হত স্কুলে বই খাতা নিয়ে যাওয়ার ব্যাগ যদি ডেস্কের মতো ব্যবহার করা যেত তাহলে কেমন হত? বা আলো না থাকলে ওই ব্যাগকেই যদি আলোর উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যায় তাহলে? প্রয়াস গড়ার পর অলোক-মণীশ প্রথমেই হাত দিলেন সেই কাজে। পুনের সিমবায়োসিস ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের ছাত্র অলোক কুমারের সংস্থা প্রয়াস তৈরি করে ফেলল ম্যাজিক ব্যগ, নাম ইয়েলো।
প্রয়াস ইনোভেশনের এই আবিষ্কার শুধু রাজ্যস্তরেই প্ৰশংসিত হয়নি, জাতীয়স্তরেও ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের পুরস্কার ও স্বীকৃতি পেয়েছে। আফ্রিকার মতো দেশে এই ব্যাগ বেশ সাড়া ফেলেছে। ‘দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে আমরা ইতিমধ্যে দু হাজারের বেশি ব্যাগ গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দিতে পেরেছি। দেশের পিছিয়ে থাকা এলাকাগুলিতে প্রত্যেক পড়ুয়ার কাছে এই ব্যগ পৌঁছে দিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, শিল্প সংস্থা এবং অন্যান্য সমাজকল্যাণমূলক সংস্থার আরও বেশি সহয়োগিতা চাইছি।আফ্রিকার দেশগুলির এনজিওদের একটি সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব আফ্রিকান এনজিওস-এর এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আমাদের এই ব্যাগ নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন’, জানান মণীশ।
বাজারে ইয়েলোর দুটি সংস্করণ পাওয়া যায়। একটি এলইডি আলোযুক্ত অন্যটি এলইডি আলো ছাড়া। দাম যথাক্রমে ৬৯৯ টাকা এবং ৩৯৯ টাকা। এলইডিযুক্ত ব্যাগে ৬ মাসের ওয়ারেন্টি থাকে। ই-কমার্সের রমরমার অনলাইনে পণ্য বিক্রির ভাবনা নেই? প্রশ্নের উত্তরে কুমারের জবাব, ‘অনলাইন সংস্থাগুলি কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মুনাফা দাবি করে। সেক্ষেত্রে ব্যাগের দাম গিয়ে পড়বে ৪৬০ টাকা মতো। তাই অনলাইনের ভাবনা ছেড়ে আপাতত কম দামে গ্রামের গরিব পড়ুয়াদের হাতে ব্যাগ পৌঁছে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য’। মণীশের সাফ কথা, ‘প্রশংসা কুড়নোর জন্য নয়, সাধারণের হাতে হাতে ব্যাগগুলি পৌঁছে দিতে চাই। রাজ্য সরকারগুলি এই উদ্যোগে সামিল হলে তবেই তা পূর্ণতা পাবে’।
ইয়েলো ব্যাগের পেটেন্ট করিয়েছে সংস্থাটি। আগামী বছর নতুন দুটি পণ্য বাজারে আনতে চলেছে প্রয়াস। এর মধ্যে একটি মহিলাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, অন্যটি মাল্টি ইউটিলিটি লো কস্ট সোলার ল্যাম্প। ইয়েলোর উন্নত সংস্করণ বাজারে আনার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয় আগামী পাঁচ বছরে অন্যান্য উদ্ভাবনী সংস্থার লগ্নীকর্তা হয়ে ওঠার পরিকল্পনা রয়েছে প্রয়াসের। সংস্থা চালাতে নিজেদের পকেট থেকে ৫০ লক্ষ টাকা তুলেছে প্রয়াস। ২০১৬ সালে লাভের মুখ দেখতে চলেছে প্রয়াস ইনোভেশন।