পানাগড় থেকে শান্তিনিকেতনের মাঝে বনকাটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার ছোট্ট গ্রাম সাতকাহনিয়া। শান্তিনিকেতন থেকে দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। অজয় নদ ও গড় জঙ্গলে ঘেরা ছবির মত গ্রাম এই সাতকাহনিয়া। এখানেই আবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটার ভিলেজ তেপান্তর।
১৫০ টি পরিবারের বাস এই গ্রামে, তার মধ্যে রয়েছেন হিন্দু ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। আটটি পরিবার বাদে প্রত্যেকেই দরিদ্র ও নিম্নবর্গের অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রামেরই সচ্ছল পরিবারগুলির একটিতে জন্ম কল্লোল ভট্টাচার্যের।
বাড়িতে বরাবরই এই সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল, বাবা দীর্ঘদিনের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী। ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে নিয়মিত যাতায়াত ছিল কল্লোলের। বইপত্রের মাধ্যমের বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে একটা যোগাযোগও ছিল, আর ছিল নাটকের প্রতি ভালবাসা। উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র, শম্ভু মিত্র, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, ঊষা গাঙ্গুলি এই নামগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে হতেই বড় হয়েছে কল্লোল। গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাটক করেছেন। তবে নাটক বলতে তখনও বুঝতেন প্রসেনিয়ম থিয়েটার। ১৯৯৪ সালে গ্রামের সেচ দফতরের ডাকবাংলোয় নাটকের কর্মশালা করাতে আসেন নাট্যকর্মী প্রবীর গুহ ও তাঁর দল অলটারনেটিভ লিভিং থিয়েটার, গ্রামে গ্রামে নিজেদের নাট্য দর্শন ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তখন নাটক করে বেড়াচ্ছেন প্রবীর। স্বাভাবিকভাবেই সেই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন কল্লোল। থিয়েটার সম্পর্কে পুরোনো ধ্যানধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় এই কর্মশালায়, নতুন এক ধরণের নাটক ও নাট্য দর্শনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। “কর্মশালায় দেখলাম খোলা আকাশের নীচে, বারান্দায় হাতের কাছে যা পাওয়া যায় সেই উপকরণ দিয়ে, শরীরের ব্যবহারে থিয়েটার হচ্ছে। উঠে আসছে মানুষের নিজেদের কথা। কোনও নাটক বা নাট্যকারের প্রয়োজন হচ্ছে না। একদল মানুষ নিজেদের মতো করে তাদের জীবনের কথা বলছেন। তাঁরা কেউ প্রথাগত নাট্য শিক্ষায় শিক্ষিত নন। কলকাতার থিয়েটার যাঁরা দেখেননি তাঁরা কী ভাবে গড়ে তুলছেন নাটক, কর্মশালাটি গভীর ছাপ ফেলল আমার মনে”, বললেন কল্লোল।
এরপর শুরু কলেজে পড়াশোনা, কিন্তু থিয়েটারের এই নতুন ফর্মটি ভাবাচ্ছিল কল্লোলকে। এর কিছুদিনের মধ্যেই ফের গ্রামে আসেন প্রবীর গুহ, শুরু হয় ব্যক্তিগত আলাপচারিতা। পরিচয় হয় তামিলনাড়ুর বিখ্যাত নাট্যকর্মী এস রামানুজনের সঙ্গে। সেই সময়ই নিজের গ্রামে দল তৈরির ইচ্ছের কথা জানান প্রবীর গুহকে ও তাঁর উৎসাহ এবং পরামর্শে শুরু করে দেন দল তৈরির কাজ।
গ্রামেরই জনা ২০ ছেলেকে নিয়ে তৈরি হল তাঁর নাটকের দল। প্রত্যেকেই দরিদ্র ও নিম্নবর্গীয় পরিবার থেকে আসা, প্রাথমিক স্তরের পর পড়াশোনা এগোতে পারেননি বেশিরভাগই। প্রত্যেকেই দিন-মজুর, ভোরবেলা বালি খাদান, ইটভাঁটা বা অন্য কোথাও কাজে চলে যান আর সন্ধেবেলা বসে নাট্যচর্চার আসর। দলের নাম দেওয়া হল ঘাসফুল থিয়েটার। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় চলত মহড়া। গ্রাম জীবনের কথা, গ্রামের সমস্যা ইত্যাদি উঠে আসত নাটকে। কখনও বিষয় শিশুশ্রম তো কখনও সাম্প্রদায়িকতা। এছাড়া রূপকথা, উপকথা নিয়েও হত নাটক, তবে প্রত্যেক নাটকেরই একটি বক্তব্য থাকত। আস্তে আস্তে পরিবারের মেয়েরাও যোগ দিতে শুরু করেন দলে। নাটক তৈরি হয়ে গেলে চলে যাওয়া হত কোনও এক গ্রামে, বাল্ব জ্বালিয়ে, হ্যাজাকের আলোয়ে কখনো বা মশাল জ্বালিয়ে চলত নাটক।
অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক নিয়ে পড়াশোনায় চালিয়ে যেতে থাকেন কল্লোল। পরিচিত হন অন্যান্য নাটকের দলের সঙ্গে। বাদল সরকারে সঙ্গে আলাপ হয়, একদিকে নাটক দেখা ও পড়াশোনা অন্যদিকে নিজের দলের নাটক তৈরি এভাবেই চলছিল। অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে মিলে বীরভূম ও বর্ধমানের বিভিন্ন জায়গায় নাট্য উত্সব করতে শুরু করে ঘাসফুল, বাড়ে পরিচিতি।
এভাবেই কাটে বছর পাঁচেক। ততদিনে তৈরি হয়েছে পরিচিতি। অভিনয়ের ডাক পড়ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। তবে দলের প্রায় সকলেই দিন মজুর হওয়ায় আরও বেশি সময় দেওয়া বা অন্য জায়গায় গিয়ে নাটক করা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দলের খরচ চালানোর জন্য দলের সদস্যরাই বালিখাদানে ট্রাক ভর্তি বা এই ধরণের কোন কাজ করে টাকা জোগাড় করতেন। এরই মধ্যে দলের নাম নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিল। এক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীক হওয়ায় সেই দলের সঙ্গে এক করে দেখা হত তাঁদের, বললেন কল্লোল, তাই নাম বদলে রাখা হল “এবং আমরা”।
ততদিনে কল্লোল ও আরও কয়েকজন ঠিক করে ফেলেছেন সর্বক্ষণের জন্য নাটককেই বেছে নেবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে পরিবারগুলি চালান হয়ে পড়বে অসম্ভব। তখনই ঠিক করেন গ্রামের পতিত জমিতে সব্জি চাষ, ফলের বাগান তৈরি, হাঁস-মুরগি পালনের কাজ করবে ‘এবং আমরা’। আয়ের একটা অংশ দল চালানোর কাজে লাগান হবে আর বাকিটা তুলে দেওয়া হবে পরিবারগুলির হাতে। এভাবেই তৈরি করা হবে সর্বক্ষণের নাট্যকর্মী। গ্রামের প্রান্তে ১২ বিঘা বুনো গাছের জঙ্গলকে বেছে নেওয়া হল, জমির মালিকের থেকে অনুমতি নিয়ে ১৯৯৯ এর শীতে জঙ্গল পরিস্কার করে শুরু করে দেওয়া হল চাষের কাজ। সারা রাত জেগে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে লাগলেন গ্রামের মানুষ। পুরো জমিটিকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে সময় লাগে ৬ বছর। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে একটি গোল চালা ঘর তৈরি হয়েছে নাটকের মহড়ার জন্য। শুরু হয়েছে হাঁস মুরগি প্রতিপালন, পাশের পুকুরে মাছ চাষ। যত সময় এগিয়েছে, বেড়েছে দলের সদস্য সংখ্যা। তৈরি হয়েছে একের পর এক নাটক।
২০০৪ সালে পুরো ক্যাম্পাসটির নাম দেওয়া হয় তেপান্তর, হয় সোসাইটি রেজিস্ট্রেশন। এবছরই কলকাতায় নাট্যমেলায় অংশ নিতে এসে পরিচয় হয় বার্লিন থেকে আসা ফ্লাইং ফিশ থিয়েটারের নির্দেশক হ্যারল্ড ফরম্যানের সঙ্গে। এরপরের বছর হ্যরল্ড ফরম্যান ও তাঁর দল তেপান্তরে এসে টানা ২০ দিনের কর্মশালা করে ‘এবং আমরা’ এর সঙ্গে। তাঁদের থাকার জন্য ছোট ছোট চালাঘর তৈরি হল, তৈরি হল পায়খানা বাথরুম। অর্থ দিয়েছিলে ফরম্যান। এরপরই প্রচার ঘটে তেপান্তরের। কর্মশালার শেষ দিনে নাটক দেখতে মানুষের ঢল নামে, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসেন নাটক দেখতে। এরপরই সিদ্ধান্ত হয় তেপান্তরকে ফার্মহাউস হিসেবে না দেখে নাট্যগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে এটাকে। সেই মত তেপান্তরের ভিতরই কর্মশালা, নাট্যোত্সব ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে দলের অনেকেই সপরিবারে তেপান্তরের মধ্যেই বসবাস শুরু করেন। নতুন নতুন স্পেস নিয়ে কাজ শুরু হয়। কল্লোল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে পরিচিত হন, পরিচিত হন তাঁদের কাজের সঙ্গে, সমৃদ্ধ হয় তাঁর নাটক। মহাকাব্যের পরে, খুনির মা, ইদিপাস আপন আলো ইত্যাদি নাটকগুলি এবং আমরাকে সর্বভারতীয় পরিচিতি দেয়।
এরই মধ্যে ২০০৬ সালে প্রবল ঝড়ে তেপান্তরের ঘর বাড়ি, হাঁস মুরগির খামার ইত্যাদি সব ভেঙে পড়ে। আবার শুরু হয় লড়াই। তৈরি করা হয় নার্সারি, সেই আয় আর নাটকের আয় থেকে পুনরায় গড়ে তোলা হয় পরিকাঠামো। ২০১০ সালে নেওয়া হয় বিদ্যুত সংযোগ। থিয়েটারের দলগুলির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারে অনুদানের কথা সেবছরই প্রথম জানতে পারেন কল্লোল, আবেদন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০১১ থেকেই অনুদান পেতে শুরু করে ‘এবং আমরা’। বর্তমানে দলের মোট সদস্য সংখ্যা ২৫, এর মধ্যে ১৫ জন সর্বক্ষণের কর্মী। সাতকাহনিয়ার বাইরে অন্যান্য গ্রাম থেকেও মানুষ যোগ দিয়েছেন দলে। তাঁদের মধ্যে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত তরুণরাও রয়েছেন।
২০১০ সাল থেকেই হয়ে আসছে জাতীয়স্তরের নাট্য উৎসব। এছাড়াও প্রতি বছর দোলের সময় হয় বসন্ত উৎসব। সারা বছরই চলে নানান কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ও নাটক। স্থানীয় মানুষ ও বাইরে থেকে আসা অতিথীদের জন্য নাটক পরিবেশন করা হয়। দেশ বিদেশ থেকে নাট্য ব্যক্তিত্বরা নিয়মিত আসেন তেপান্তরে। এখানে রয়েছে ২০ জনের থাকার ব্যবস্থা, মুক্তমঞ্চ ও আটচালা। এটিকে একটি সাংস্কৃতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তুলছেন কল্লোল।
“আমাদের কাজ সমাজের অবহেলিত প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, নাটকের মাধ্যমেই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের পরিচয় ঘটে। নাটকই তাঁদের যাপন, তাঁদের সম্মান। আমি আমার স্ত্রী মেয়ে সবাই থিয়েটারটাই করি। দেশে বিদেশে আমাদের কাজের কথা পৌঁছেছে। বাংলাদেশে নাটক মঞ্চস্থ করেছি আমরা, এছাড়া দেশের অন্যান্য শহরেও নাটক পরিবেশন করেছে ‘এবং আমরা’। তেপান্তরকে একটি সম্পূর্ণ নাট্যকেন্দ্র হিসেবেই গড়ে তুলতে চাই আমি। প্রয়োজন পরিকাঠামোগত উন্নয়ন”, বললেন কল্লোল।