কর্মচারীদের উৎপাদনশীল রাখা ও কাজে উৎসাহিত করার আটটি উপায়

কর্মচারীদের উৎপাদনশীল রাখা ও কাজে উৎসাহিত করার আটটি উপায়

Saturday November 28, 2015,

6 min Read

উৎপাদন ক্ষমতার বিষয়টি যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত শুরুয়াতি সংস্থার ক্ষেত্রে। অনেকসময়ই শুরুয়াতি সংস্থার কর্মীদের প্রতি উদ্যোক্তার অতিরিক্ত প্রত্যাশা, তাদের থেকে আরো বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, অনেক বেশি দক্ষ ও উদ্যোগী বলে ভেবে নেওয়ার ফলে যেটা হয় যে, কর্মীদের উপর প্রচুর চাপ পড়ে যায়। সংস্থার মালিককে নিজে যদি এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হত, তাহলে তাঁর অবস্থাও এর থেকে আলাদা কিছুই হতনা।

উদ্যোক্তারা অনেকসময়ই কর্মচারীদের মানসিকতা ও তাঁদের ব্যবহারিক গুণ তথা বৈশিষ্ট্যাবলি সমন্ধে অবগত থাকেননা। প্রতিষ্ঠাতার সাথে কর্মচারীদের রক্তের ‘গ্রুপ’ এক হতে পারে। এমনকি হতে পারে যে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণও হয়তো এক। কিন্তু যেখানে ফারাক থাকবে, অন্তত থাকাটা একান্তই সম্ভব, সেটা হল ভাবনার পদ্ধতি।



image


অর্থাৎ, আসল কথা হল যে কর্মীদের কোনোকিছু শেখবার দৃষ্টিভঙ্গি, তাঁদের ‘EQ’ বা ‘IQ’ এর মত বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। এটাই হয়তো আপনার ব্যবসাকে অবনতি হওয়ার থেকে বাঁচাতে পারে। মনে রাখবেন, সৈনিকরা যদি হতাশ হয়ে পড়ে, যদি তাদের মধ্যে কোনো উৎসাহ না থাকে, তাহলে সেনাপতি যতোই ভাল হোন না কেন, তিনি ব্যর্থ হতে বাধ্য।

নিজের হাতে সংস্থা/ব্যবসা গড়ে তোলা কোনো উদ্যোক্তার কাছে নিজের কর্মীদলকে উজ্জীবিত ও উৎপাদনশীল করে রাখাটা বেশ কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ নয়। কিন্তু যে আটটি বিষয়ের কথা আমি বলতে চলেছি, সেগুলির রুপায়ণের মধ্যে দিয়ে কর্মীদেরকে উজ্জীবিত রাখা ও তাঁদের উৎপাদনশীলতা সর্বদা উর্দ্ধমুখী রাখাটা সম্ভব।


‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট’ পার্টি দিন-

ক্রিসমাসের সময় বা যেকোনো উৎসবের সময় ‘পার্টি’ খুবই সাধারণ বিষয়। কিন্তু ‘হোয়াইট এলিফ্যান্ট পার্টি’র ক্ষেত্রে কর্মীদের মধ্যে বেশ আগ্রহ ও উত্তেজনা দেখা যায়। যে কটা হোয়াইট এলিফ্যান্ট পার্টিতে আমি গেছি, সব জায়গাতেই দেখেছি অতিথিদের খুব আনন্দ করতে, হাসতে। কেউ কেউ যেমন নিজের পছন্দমত কোনো উপহার পেতে চেষ্টা করে, তেমনই কেউ কেউ আবার বিভিন্নভাবে চায় এরকম জমায়েত এড়িয়ে যেতে। এবং এরকম পার্টির বহুদিন পর অবধিও দেখবেন যে, কর্মচারীরা কাজে আসছেন রীতিমত মানসিক প্রফুল্লতা নিয়ে। 


অফিসের সুন্দর ও আকর্ষক অন্তর্সজ্জা এবং প্রাণবন্ত কর্মপরিসর

গতকাল রাতে অফিস থেকে ফেরার পর আমায় দেখে আমার বান্ধবী অবাক হয়ে বলেছিল “তোমাকে তো এখনো ফ্রেশ দেখাচ্ছে” । “কারণ আমার অফিসটা ভীষণ সুন্দর, তাই” উত্তর দিয়েছিলাম আমি। অফিসের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ প্রাকৃতিক হাওয়া চলাচলের ব্যবস্থা থাকলে এবং রঙ ছিমছাম হলে, আমায় যদি সারাদিন জাভা অ্যাপলেট নিয়ে পড়ে থাকতে হয়, তাহলেও আমার ক্লান্তি বোধ হবেনা। মন উৎফুল্ল থাকবে। নিজের সময়মতো কাজ করার সুবিধা থাকা ও মাঝে মাঝে ‘ন্যাপ’ নেওয়ার ফলে আমি কাজের সময় নিজের সেরাটা দিতে পারি, এবং প্রচুর চাপ পড়ছে বলেও কখনো মনে হয়না।

সংক্ষিপ্ত ও অঘোষিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচী -

প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে কর্মচারীদের ব্যক্তিত্ব, গুণাগুণ সমন্ধে জানা যায় এবং পাশাপাশি কর্মীদেরও কাজ সমন্ধে বুঝতে সুবিধা হয়। এটা বেশ ভালো বিষয়, কারণ এতে করে কর্মীরা নিজেদের পেশাগত দক্ষতার ক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং এটার ফলে যেটা হয় যে কাজ ‘চাপিয়ে’ দেওয়ার বদলে সেই কর্মীর দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব অনুসারে তাকে কাজের দায়িত্ব দেওয়া সম্ভবপর হয়। কর্মচারীদের এই আত্মপলব্ধি তাঁদের নিজদের সমন্ধে ও পাশাপাশি সহ-কর্মচারীদের দক্ষতা ও ব্যক্তিত্ব সমন্ধে বুঝতেও সহায়তা করে। যার ফলস্বরুপ ওনাদের পক্ষে আপনার নেতৃত্বে একসাথে, একটা ‘টিম’ হিসাবে কাজ করা সম্ভব হয়। 


কর্মচারীদের ক্ষমতা ও দক্ষতাকে গুরুত্ব দিন -

কর্মচারীদের উৎপাদিকা শক্তি তখনই বৃদ্ধি পায় যখন তাঁরা নির্ভয়ে, দ্বিধাহীনভাবে নিজস্ব দক্ষতাকে কাজে ব্যবহার করতে এবং খোলামনে কাজ করতে পারেন। এবং কার্যক্ষেত্রে ওনাদের ভিন্ন ভিন্ন গুণাবলিকে গুরুত্ব দিলে ওনারাও আপনার সংস্থার সাথে একাত্ম বোধ করবেন এবং কাজের উৎসাহ পাবেন। আপনার কর্মীদের মধ্যে কেউ যদি তৃতীয় বিশ্বের সমস্যা নিয়ে ভাবিত হন, তাহলে তাঁকে পোশাক সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করুন। বয়েস দিয়ে বিচার করবেন না। অনেকে কম বয়েসেও এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেটা অন্যদের পক্ষে ভাবা সম্ভব নয়।


স্থানীয় স্তরে খেলাধূলা ও সামাজিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করুন –

স্বল্প মূলধন নিয়ে পথ চলা শুরু করেছে, এরকম সংস্থায় কর্মচারীদের সাথে উদ্যোক্তার এমন এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেটা বড় সংস্থার ক্ষেত্রে বিরল। স্থানীয় স্তরে খেলাধূলা, যেমন ম্যারাথন দৌড় বা এরকম কিছুতে অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করে নেওয়ার পাশাপাশি সমাজকল্যাণমূলক লক্ষ্যে কোনো এনজিও’র সাথেও কাজ করতে পারেন। এর ফলে শুধু যে কর্মক্ষেত্রে সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পাবে তাই নয়, বরং একটা সামাজিক উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে কাজ করায় আপনার কর্মচারীরাও সন্তুষ্ট হবে।

এইগুলি আপনার সংস্থাকে ‘সংস্থা’ হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এবং আপনারা একসাথে, সম্মিলিতভাবে, দলবদ্ধভাবে কাজ করতে সক্ষম হবেন।


খাবার কিংবা অন্য কিছু এনে কর্মচারীদের চমক দিন -

আপনি যে আপনার কর্মচারীদের কথা ভাবেন, সেটা বোঝানোর জন্য কখনো ওনাদের ‘ট্রিট’ দিতে পারেন। অফিসে খাওয়াতে পারেন পিৎজা বা ডোনাট। আপনি যদি ওনাদের প্রথম নাম ধরে ডেকে নিজে হাতে ওনাদের খেতে দেন, তাহলে ওনারা আপনার অমায়িক ব্যবহারে খুশি হবেন এবং আপনি যে ওনাদেরকে গুরুত্ব দেন, সেটা অনুভব করতে সক্ষম হবেন। একটু ভাবলেই কিন্তু কর্মীদের কার্যক্ষমতা আরো বাড়িয়ে তোলা এবং কাজের পরিসরকেও আরো প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব।


কর্মচারীদের ছুটি দিন –

আপনি যে আপনার কর্মচারীদের কাছে কৃতজ্ঞ, সেটা বোঝাবার জন্য সবেতন ছুটি দিন। খুব বেশি ছুটি দেওয়ার কথা আমি বলছিনা। ধরুন যাদের সন্তানসন্ততি রয়েছে, তাদেরকে আধবেলা ছুটি দিলেন যাতে তারা বাচ্চার স্কুলে কোনো অনুষ্ঠানে কিংবা ছাত্র/ছাত্রী - শিক্ষক/শিক্ষিকা মিটিং এ উপস্থিত থাকতে পারেন। কারুরু ঠান্ডা লেগে শরীর খারাপ হয়ে গেলে তাকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। আপনার কর্মচারীরা খুশি হবেন।


পারিবারিক যোগাযোগ স্থাপন -

শুরুয়াতি উদ্যোগে যুক্ত হওয়া অধিকাংশ কর্মচারীই হয় সদ্য পাশ করা কলেজের ছাত্র-ছাত্রী কিংবা শিক্ষানবিশ। আপনি যে ওদের খেয়াল রাখেন, সেটা বোঝাবার জন্য ওনাদের অভিভাবক, ভাই-বোনের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন। কখনো বা একটা পিকনিক এর আয়োজন করতে পারেন যেখানে উদ্যোক্তা ও কর্মীদের মধ্যে কোনো ফারাক থাকবেনা এবং আপনি তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে পরিচিত হবার, মেশার সুযোগ পাবেন। এই ধরনের যোগাযোগ কর্মচারীদের সাথে সংস্থার একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং সংস্থার সাথে তাদেরকে যুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নেয়।


কাজের চাপ কখনো-সখনো কম রাখুন-

স্বল্প বিনিয়োগকে সঞ্চয় করে ব্যবসায় নামা একটি সংস্থার চাহিদা হরেক। কর্মীদের উপর কখনো কখনো চাপ কমিয়ে দেওয়াটা ওনাদেরকে কাজে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে, যেটা শেষ বিচারে উর্ধগামী করবে আপনার সংস্থার উৎপাদনকেই। সংস্থার সাফল্য উদযাপন করার জন্যও কিছুটা সময় রাখুন।

সময় জিনিসটা খুবই মূল্যবান। সময়ের অর্থ হল টাকা।

আমি জানি যে এখানে বহুজাতিক সংস্থা নয়, বরং আলোচনা হচ্ছে শুরুয়াতি উদ্যোগ নিয়ে। তাই এখানে উল্লিখিত কিছু বিষয় অবাস্তব ঠেকতে পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, সাত থেকে ১০ টা শুরুয়াতি উদ্যোগই কিন্তু ব্যর্থ হয় নিজেদের অভ্যন্তরীন গলদের জন্যই।

যারা নিজের কর্মচারীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণভাবে মেলামেশা করেন, তাঁদের খেয়াল রাখেন, তাঁরা কর্মীদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে দূরত্ব বজায় রেখে চলা উদ্যোক্তাদের চেয়ে অনেক দ্রুত ও বেশি সহজে বিভিন্ন সমস্যা মিটিয়ে নিতে পারেন। এক অন্য মাত্রা দিতে পারেন নিজের শুরুয়াতি উদ্যোগকে।

সংস্থার সাফল্যের জন্য কর্মচারীদের উৎসাহ ও উৎপাদন ক্ষমতা গড়ে তোলা ও সেটাকে ধরে রাখাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উপরে উল্লিখিত এই আটটি পরামর্শ মেনে চললে আপনার স্বল্প মূলধনের উদ্যোগে কর্মচারীরাই হয়ে উঠবে আপনার আসল সম্পদ। যেখানে আপনার কর্মচারীরা সন্তুষ্ট থাকবে ও কাজে উৎসাহ পাবে, এরকম এক কাজের পরিবেশ তৈরি করতে পারলে সেটা কাজের প্রতি সংস্থার ও সংস্থার মালিকের দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করবে, এবং শেষবিচারে লাভজনক হবে সংস্থার পক্ষে।

শুভেচ্ছা রইল আপনাদের জন্য।


লেখক - অমিত ঘোষ

অনুবাদ - সন্মিত চ্যাটার্জী