কলকাতায় 3D প্রিন্টিং মানে সমিত-অমিতের সৃজন
ইন্টারনেটে সাড়া জাগানো শর্ট ফিল্ম সুজয় ঘোষের অহল্যা। ছবিতে শিল্পী গৌতম সাধু এক জাদু পাথরের ছোঁয়ায় তাঁর বাড়িতে আসা মানুষদের পতুলবন্দি করতেন। রক্ত-মাংসের মানুষটার সঙ্গে সেই পতুলের হবহু মিল। রিলের মতো রিয়েল লাইফে জাদু পাথরের সাহায্য পাওয়া না গেলেও 3D প্রিন্টং নামক প্রযুক্তিতে ভর করে যেকোনও কিছু সহজেই রেপ্লিকেট করা যেতে পারে। বাড়ি, গাড়ি থেকে থ্রিডি সেলফি– প্রমাণ সাইজের রেপ্লিকা তৈরি করা যেন 'বাঁ হাতের খেল'। কাগজ, কাঠ, প্লাস্টিক, ধাতু হাতের কাছে যা কিছু তা দিয়েই থ্রিডি প্রিন্টআউট তৈরি করা যায়। কলকাতার বাজারে এই থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিকেই দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে জুড়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে সৃজন ক্রিয়েশন।
পারিবারিক গয়না তৈরির ব্যবসায় আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে থ্রিডি প্রিন্টিং নিয়ে কাজ করছিলেন উত্তর কলকাতার সিমলে অঞ্চলের বাসিন্দা সমিত দাস। দক্ষিণের হরিদেবপুরের বাসিন্দা অমিত চৌধুরী আদ্যন্ত মার্কেটিংয়ের লোক। ২০১৪ সালে দু’জনের হঠাৎ আলাপ, ভাবনাচিন্তার আদানপ্রদান এবং গত এপ্রিলে বাণিজ্যিকভাবে সৃজন ক্রিয়েশনের শুরুয়াত।
বুটস্ট্র্যাপ। মানে নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করেই শুরু। প্রাথমিকভাবে সমিতের পরিকল্পনা ছিল থ্রিডি ডিজাইনিং প্রিন্টিংয়ের ট্রেনিং কোর্স চালু করা। কিন্তু থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের প্রয়োগ নিয়ে গবেষণাই সৃজন ক্রিয়েশনের সামনে সুযোগের নতুন দরজা খুলে দেয়। সমিত, অমিতরা নিজেরাই বানিয়ে ফেলেন থ্রিডি প্রিন্টার। লাখ লাখ টাকার বিদেশি যন্ত্রের তুলনায় বেশ সস্তা। শুধু মেশিন বানিয়ে থেমে না থেকে কলকাতায় গয়না তৈরির কাজে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রযুক্তিকে তারা পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়ে দেন। থ্রিডি প্রিন্টারে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ডিজাইনের ছাঁচ তৈরি করে গয়না বানালে সময় তো বাঁচেই, গয়না নিখুঁতও হয়। অমিতবাবু জানিয়েছেন, “গোটা ব্যাপারটাই বেশ কস্ট এফেক্টিভও”। সৃজনের এই এক্সপেরিমেন্ট বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
অমিত চৌধুরী বলেন, “থ্রিডি প্রিন্টিং ব্যাপারটা এদেশে নতুন হলেও প্রযুক্তিটা সেই ১৯৮০ সালের। আন্তর্জাতিক মহাকাশ কেন্দ্রের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার হচ্ছে থ্রিডি প্রিন্টার। এদেশে মুম্বই, চেন্নাইতেও অনেকদিন হল এই প্রযুক্তির ব্যবহারে চুটিয়ে কাজ হচ্ছে। কিন্তু কলকাতায় এই প্রযুক্তি এখনও সেভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি”। তিলোত্তামার সঙ্গে এই আপাত এলিয়েন প্রযুক্তির পরিচয় করানোটাই একটা হার্ডেল। থ্রিডি প্রিন্টিং কী, এবং তার প্রয়োগ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতেই শেষ এক বছরে বিভিন্ন কলেজ, ইউনিভার্সিটির ফেস্টে ছুটে বেড়িয়েছেন সৃজনের দুই শীর্ষকর্তা। বিদেশ থেকে আধুনিক যন্ত্র রফতানি করে চলেছে R&D। কখনও পকেটে টান পড়ায় শিল্প মেলাতে স্টল ভাগাভাগি করে ডেমনস্ট্রেশন চালিয়েছেন, কখনও স্টল ভাড়া না নিতে পেরে স্রেফ লিফলেট বিলি করেই থ্রিডি প্রিন্টিং নিয়ে প্রচার চালিয়েছেন।
গয়না তৈরিতে তাদের প্রয়োগ সফল হওযার পর সৃজন ক্রিয়েশনের নজর এখন চিকিৎসা ক্ষেত্র। মাথার খুলির একটা থ্রিডি প্রিন্টআউট হাতে নিয়ে অমিত চৌধুরী বললেন, “CT Scan, MRI এর তথ্যের থ্রিডি প্রিন্টাআউট নিয়ে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় অনেকটাই সুবিধে হবে”। কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ কীভাবে করা যায় তা নিয়ে কলকাতায় National Institute of Orthopedically Handicapped–এ ওয়ার্কশপ করেছে সৃজন ক্রিয়েশন। Maxillofacial Surgery–তে থ্রিডি প্রিন্টিং প্রয়োগ করা নিয়ে AIIMS, পাটনার সঙ্গে তাদের কথাবার্তা হয়েছে।
2D প্রিন্টার আজ যেমন লোকের ঘরে ঘরে, অফিস, কলেজ সব জায়গায় তার ব্যবহার, 3D প্রিন্টিং প্রযুক্তিকেও ততটাই জনপ্রিয় করে তুলতে চায় সৃজন ক্রিয়েশন। আগামী দিনে তাদের লক্ষ্য স্কুল কলেজে এই প্রযুক্তি শেখানো। বর্তমানে থ্রিডি প্রিন্টার বিক্রি করলে, হাতে কলমে তার ব্যবহার শিখিয়ে দেওয়া হয় সৃজন ক্রিয়েশনের তরফে। অমিত চৌধুরী বললেন, “Selfie ম্যানিয়ার দৌলতে এখন থ্রিডি সেলফি নিয়ে মানুষের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে, সুজয় ঘোষের অহল্যা সেই আগ্রহকে আরও খানিকটা বাড়িয়েছে বটে। তবে, যেদিন দেখব থ্রিডি প্রিন্টার গেরস্থের হেঁসেলেও পৌঁছে গেছে, সেদিন বুঝব আমরা সফল”।
3D প্রিন্টিং প্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে উদ্ভাবনের স্বীকৃতি হিসেবে এগিয়ে বাংলা এপিসোড উইনার হয়েছে সৃজন ক্রিয়েশন। এই সাফল্যকে পুঁজি করেই আগামীর স্বপ্নের দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপ রাখতে চান অমিত চৌধুরী ও সমিত দাস।