অ্যাথলিট তৈরির কারখানা চালান দ্রোণাচার্য কুন্তল
তৈরি করেন প্লেয়ার। আজ থেকে নয়, সেই ১৯৭৬ থেকে। এক নয় দশ নয়, চল্লিশটা বছর।কুন্তল রায়। সরকারি সম্মান অবশ্য বিশেষ পাননি। আজকের দ্রোণচার্যকে দ্রোণাচার্য পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০১১ পর্যন্ত। কিন্তু সাধনা থেকে তাঁকে সরায় সাধ্য কার! তাঁর কথায় সৃষ্টির আনন্দই সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি স্রষ্টার। সোদপুরে নিজের বাড়ির সংলগ্ন একটি ছোট্ট মাঠে চলে তাঁর কোচিং ক্যাম্প- অ্যাথলেটিক কোচিং ক্যাম্প। আসলে কোচিং ক্যাম্প না বলে বলা ভাল খেলোয়াড় তৈরির আখড়া। সোমা বিশ্বাস, সুস্মিতা সিংহ রায়,সঞ্জয় রাইয়ের মত অ্যাথলিট তুলে এনেছেন তিনি।
কিন্তু কেমনভাবে তৈরি হলেন এই কারিগর ? দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এদেশে আসা। বাবা আগেই এসেছিলেন তারপর পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে কলকাতায় এসে শুরু নতুন করেন নিজেদের পরিচয় বানানোর লড়াই। এসে উঠলেন চাকদায়। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন ছোট্ট কুন্তল। বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়া তখন রীতিমতো কৃতিত্বের বিষয় ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের বৃত্তি পরীক্ষায় সুযোগ পেয়েছিলেন। কলকাতায় এসে সোদপুরে বসবাস শুরু করার পর বেলঘড়িয়া হাই স্কুলে পড়াশুনা। তখনও অবধি খেলাটা সেভাবে জাঁকিয়ে বসেনি। তবে রক্তে ছিলই। নিজেদের বাড়ি ও মামার বাড়ি দুদিকেই ছিল খেলার প্রতি দারুণ ভালবাসা। স্পোর্টস ম্যাগাজিন-স্পোর্টস এন্ড পাসটাইম-নিয়িমত আসত বাড়িতে। স্পোর্টসের নেশা বাড়িয়ে দিয়েছিল এটাই। এরপর স্কুলের সূত্র ধরেই খেলাধুলোর জগতে প্রবেশ।
শুরুর জীবনে ছিলেন ফুটবলার। বিভিন্ন স্কুল প্রতিযোগিতার পাশাপাশি খেলেছেন সুব্রত কাপের মত টুর্নামেন্টেও। কিন্তু একটা দুঘর্টনা তাঁর পা থেকে ছিনিয়ে নেয় ফুটবল। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। এবার জীবনে এল অ্যাথলেটিক্স। ১৯৬৯ শুরু করেন অ্যাথলেটিক্স। রাজ্যস্তরের খেলায় অংশ নিতে শুরু করেন ৭০। আর ৭১ এ পা রাখেন জাতীয় স্তরে টুর্ণামেন্টে।নিজে ১০০ মিটার লং জাম্প করতেন। এরপরই পাশাপাশি চলে কোচিংয়ের ট্রেনিংও। ৭৬ সালে প্রথম চাকরি পেলেন কোচ হিসেবে। ত্রিপুরায় পোস্টিং।
জীবনের নানা উত্থান পতন দেখেছেন এই কোচিং পর্বে। তবে সেসব নিয়ে ভাবেন না আজ। তবে মনে ভাললাগাগুলো রয়ে গেছে। জাতীয় কোচিং ক্যাম্পে তৈরি হওয়া যে সব অ্যাথলিটকে ট্রেনিং দিয়েছেন তাদেঁর সঙ্গে নিজের নাম জড়ানোয় বিশেষ আগ্রহ নেই। তাই অঞ্জু ববি জর্জ, জে জে শোভাদের জাতীয় ক্যাম্পের দায়িত্ব সামলালেও এই সব অলিম্পয়ানদের সঙ্গে নাম জুড়ে কৃতিত্ব দাবি করতে দেখা যায়নি তাঁকে। বরং কুন্তলের অনেক বেশি আগ্রহ যে অ্যাথলিটদের তিনি নিজে তৈরি করেছেন। সোমা বিশ্বাস, সুস্মিতা সিংহরায় সঞ্জয় রাই এই তিন অলিম্পিয়ানকে নিজের হাতে তৈরি করেছেন কুন্তল।
নিজের এই সৃষ্টির দিকে তাকালে আলাদা সন্তোষ অনুভব করেন। আসলে কুন্তল রায় জানেন, তৃণমূল স্তর থেকে প্রতিভা তুলে আনার আনন্দটা। হিরের কদর করার জহুরির চোখ যে তাঁর আছে এতে আজ আর কোনও সন্দেহ নেই। বিভিন্ন গ্রাম থেকে তুলে আনেন প্রতিভা। তারপর চলে অনর্গল পরিশ্রম। ঘষে ঘষে পাথরে নিয়ে আসেন ঔজ্জ্বল্য। তিনি সবচেয়ে জোর দেন অনুশীলন আর অনুশাসনের ওপর। আসলে সাফল্য পেতে গেলে অনুশাসন যে খুব প্রয়োজনীয় তা জানেন অভিজ্ঞ এই কোচ। শুধু অলিম্পিকই নয়, বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশ নিয়েছেন তাঁর দুই ছাত্র –ছাত্রী- সঞ্জয় রাই ও সুস্মিতা সিংহরায়। নিজে লংজাম্প করলেও হার্ডলস বোধহয় কুন্তল রায়ের অন্যতম পছন্দের ইভেন্ট। তাই কখনই থামতে চান না অভিজ্ঞ এই কোচ। আরও নতুন প্রতিভা তুলে আনার কাজে ব্যস্ত তিনি। সাইয়ের কোচের পদ থেকে বছর দুয়েক হল অবসর নিয়েছেন। কিন্তু নিজের কোচিং ক্যাম্পের কাজে এখনও সদাব্যস্ত। একটা অর্জুন নয় – এই দ্রোণাচার্যের স্বপ্ন অনেক অনেক অর্জুন তৈরি করা।