কলকাতাকে স্মার্ট ফুড সিটি বানাবে 'ফ্লেক্সিমিল'

কলকাতাকে স্মার্ট ফুড সিটি বানাবে 'ফ্লেক্সিমিল'

Saturday February 06, 2016,

6 min Read

কলকাতা শহরে একা থাকেন, বাইরের খাবার খেয়ে খেয়ে বাড়ির খাবারের স্বাদই ভুলতে বসেছেন? অথবা বাড়িতে আপনি ছাড়া রান্না করার কেউ নেই, অথচ অফিসে হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরে রান্না করতে কালঘাম ছুটছে ? শুধুমাত্র কলকাতা কেন, যেকোনও বড় শহরেই এই সমস্যা নিত্যদিনের। আর এই সমস্যার মুশকিল আসান করতেই এবার হাজির ফ্লেক্সিমিল। মোবাইল অ্যাপ বা কম্পিউটারের মাউসে কয়েকটা ক্লিক। ব্যস্‌ একেবারে হাতেগরম, বাড়ির তৈরী খাবার আপনার কাছে পৌঁছে দেবে এই শহরেরই তরুণ উদ্যোগপতি আন্তন ভট্টাচার্য - র এই সংস্থা।

image


কীভাবে কাজ করে ফ্লেক্সিমিল?

এটি একটি ইন্টারনেট ওনলি, ক্লাউড বেস্‌ড মিল অর্ডারিং প্ল্যাটফর্ম যা আপনার নিকটবর্তী এলাকা থেকেই কোনও বাড়ির শেফের তৈরী হাতেগরম, সুস্বাদু খাবার পৌঁছে দেবে আপনার বাড়ি, বা অফিসে। গ্রাহকদের পছন্দ অপছন্দের বিষয়টিতে বিশেষভাবে নজর দেয় এই সংস্থা। সেই কারণেই এক একদিন এক একরকম মেনু পাবেন এখানে। আপনি অর্ডার করার পর আপনার পছন্দের সময় জানিয়ে দিন সংস্থাকে। ঠিক সেই সময়েই আপনার কাছে খাবার নিয়ে হাজির হবেন সংস্থার ডেলিভারি বয়।

image


অত্যাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এবং সুনিপুণ রন্ধনশিল্প - এই দুয়ের উপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আন্তনের এই উদ্যোগ।

"ফ্লেক্সিমিল-এ আমরা কোনও তৃতীয় ব্যক্তি বা রেস্তোরাঁর উপর নিভর্র করি না। আবার আমাদের কিন্তু নিজেদের রান্নাঘরও নেই। আমরা এখানো ওপেন সোর্স কিচেন কনসেপ্ট নিয়ে এসেছি। যার ফলে কোনও এলাকার বিভিন্ন হোম বেস্‌ড শেফ-রা এক ছাতার তলায় আসতে পারছেন। এখানে কেউ অর্ডার দেওয়ার পরেই রান্না করা হয়,ফলে খাবার নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না," জানালেন আন্তন।

অর্থাৎ ফ্লেক্সিমিল এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে যেসব মানুষ, বিশেষত মহিলারা প্রতিদিন নিজেদের পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না করেন, তাঁরা চাইলেই এই রান্না করে অন্যকে খাইয়ে রোজগার করতেই পারেন। বহু হোম-বেস্‌ড শেফ, গৃহবধূ, বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা সদস্য, পার্ট টাইম শেফ, হোটেল ম্যানেজমেন্ট ছাত্রছাত্রী, ইতিমধ্যেই এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। নিজেদের ফাঁকা সময়ে এবং সুবিধা অনুযায়ী তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের FSSAI অনুমোদিত রান্নাঘরে রান্না করছেন। এক্ষেত্রে সংস্থার সঙ্গে কাজ করতে চেয়ে কোনও ব্যক্তি আবেদন করলে ফ্লেক্সিমিলের তরফেই শহরের কোনও নামকরা রেস্তোরাঁর শেফ-এর তত্ত্বাবধানে আবেদনকারীর জন্য ওরিয়েন্টেশন সেশনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর FSSAI এ নথিভুক্তকরণ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হওয়ার পর ওই ব্যক্তির স্মার্টফোনে সংস্থার অ্যাপ্লিকেশনের Chef Module দিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা যে দিনগুলিতে সংস্থার হয়ে কাজ করতে চান সেই দিনগুলিতে তাঁদের ফোনে সমস্ত নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রান্না হয়ে গেলে ফ্লেক্সিমিল-এর ডেলিভারি এক্সিকিউটিভরা সেটি শেফ-এর কাছ থেকে সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে দেন।

বছরখানেকের ভাবনাচিন্তা, তারপর বেশ কয়েকমাসের মার্কেট রিসার্চ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১৬-র জানুয়ারি মাস থেকে হাতেকলমে কাজ শুরু করেছে ফ্লেক্সিমিল। এই মুহূর্তে আন্তনের নিজস্ব ফার্ম AntonnovA Technologies-এর অধীনে রয়েছে এই সংস্থা। বর্তমানে এটি রাজ্য FSSAI-এ নথিভুক্ত হলেও শীঘ্রই নিজের সংস্থাকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষিত, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়া স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া প্ল্যানের অন্তর্ভু্ত করতে চান আন্তন।

মূলত তিনটি বিষয়কে মাথায় রেখেই ফ্লেক্সিমিল গড়ে তোলার ভাবনাচিন্তা শুরু হয়:

১. অনলাইন ফুড অর্ডারিংয়ের ক্ষেত্রটি কলকাতায় সেভাবে এক্সপ্লোর করা হয়নি বললেই চলে। গত তিনবছর বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করার সুবাদে আন্তন নিজে খুব কাছ থেকে সেখানে স্পুনজয়, ফ্রেশমেনু, ফুডপান্ডা, টাইনিআউল-এর মতো বিভিন্ন সংস্থাকে গড়ে উঠতে দেখেছেন এবং তিনি নিজে এই সংস্থাগুলির গ্রাহকও ছিলেন। নিজে বাইরে থাকার ফলে বাড়ির খাবার না পাওয়ার অসুবিধাটা জানতেন। আর সেই জায়গা থেকেই এধরণের কিছু গড়ে তোলার ভাবনাচিন্তা শুরু।

২. শুধুমাত্র বেঙ্গালুরুতে নয়, দেশের বিভিন্ন বড় শহরে শুধুমাত্র তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রেই অন্তত কয়েক লক্ষ কর্মচারী রয়েছেন। এদের অধিকাংশই বাড়ি থেকে দূরে অন্য শহরে কাজ করেন। ফলে কলকাতার এই বাজার ধরার পরিকল্পনা করে ফেলেন আন্তন। নিজে থেকে সল্টলেক, নিউটাউন সহ মহানগরীর তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে যাতায়াত শুরু করেই বুঝতে পারেন, কলকাতায় এধরণের ব্যবসার সম্ভাবনা রয়েছে। অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় নির্দিষ্ট সময়ের পর খাবার পাওয়া যায় না। আবার অনেকেই নিজেদের শিফ্টের সঙ্গে মানানসই সময়ে সঠিক খাবার পান না। আর যেখানেই খাওয়া হোক না কেন, বাড়ির খাবারের স্বাদ কেউই পান না। এই জায়গাগুলিই বিশেষভাবে ভাবিয়েছিল আমাদের এপ্রজন্মের এই উদ্যোগপতিকে।

৩. অন্যদিকে নিজের বাড়িতে একটি জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন আন্তন। সপ্তাহের প্রত্যেকদিন, একটি নির্দিষ্ট সময়ে টেলিভিশনে একটি বিশেষ রান্নার অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা এবং তাতে গৃহবধূদের অংশগ্রহণের প্রবল ইচ্ছে। পাশাপাশি এশহরে ফুড ব্লগারের সংখ্যাও কম নয়। তিনি উপলব্ধি করেন, শুধুমাত্র টিভি-তে দেখা যাবে বা সামান্য পারিশ্রমিক আসবে এই ভাবনা থেকেই যদি এত মানুষ রান্নাবান্না নিয়ে এত উৎসাহী হতে পারেন, তাহলে তাঁদের উৎসাহকে তো ফ্লেক্সিমিল-এর মতো প্রকল্পে কাজে লাগানো যেতেই পারে।

তবে এই ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি FlipKart,Ola Cabs এবং Oyo Rooms-এর মতো সংস্থার বিজনেস মডেল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আন্তন কে। তিনি বলছেন, "FlexiMeal’s vision is to crowd source (inspired from Oyo) the kitchen, standardize the service (inspired from Ola) and leverage an online e-commerce platform (inspired from FlipKart) in order to reach a larger client base, anywhere in the city or the country at a later stage"

এপর্যন্ত শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভালো সাড়া পেয়েছে ফ্লেক্সিমিল। মূলত সোশ্যাল মিডিয়া এবং ফ্লেক্সিমিল অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ থেকেই বেশি গ্রাহক পেয়েছে এই সংস্থা। টিসিএস, উইপ্রো, কগনিজ্যান্ট-এর মতো সংস্থায় কর্মরতদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্ডার পাচ্ছেন তাঁরা। বিশেষত টিম লাঞ্চ বা বিশেষ কোনও সেলিব্রেশন ট্রিটের ক্ষেত্রে বড় অর্ডারও আসছে। ধীরে ধীরে গৃহবধূরা এবং বহু হোটেল ম্যানেজমেন্ট স্নাতকরাও এই সংস্থার সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করছেন। সব মিলিয়ে এপর্যন্ত পরিকল্পনামাফিক এগোতে পেরেছে আন্তন এবং তাঁর সংস্থা। তবে এখনও অনলাইনে খাবার অর্ডারের বিষয়টি এশহরের মানুষের কাছে রোজকার অভ্যেসে পরিণত হয় নি। এই জায়গাটা মাঝেমাঝেই ভাবায় তাঁকে।

‌ধীরে ধীরে এই শহরের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছতে চায় ফ্লেক্সিমিল। বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থা এবং B2C সার্ভিস প্রভাইডার যেমন ভারতীয় রেলওয়ে এবং ওলা উবারের মতো সংস্থার সঙ্গে কাজ করার পরিকল্পনাও রয়েছে আন্তন ভট্টাচার্য-র। দেশের বাইরেও নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মিলে সংস্থার কাজের পরিধি বাড়ানোর কথা ভাবছেন তিনি। প্রযুক্তিগতভাবে কীভাবে আরও উন্নতি করা যায় সেই পরিকল্পনাই করছেন তাঁরা। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আনম্যান্‌ড ড্রোন-কে কাজে লাগিয়ে নিউ জার্সি এবং সংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী ভারতীয়দের তৈরী খাবার ডেলিভারির কাজ শুরু করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

এপর্যন্ত আন্তন তাঁর পুরো টিমকে নিয়ে যতটা এগোতে পেরেছেন তার অনেকটা কৃতিত্ব তিনি নিজের পরিবারকে দিতে চান। তাঁর ব্যবসায় পরিবারের সদস্যরা, বিশেষত তাঁর দিদিমা সাধনা চক্রবর্তী যেভাবে এগিয়ে এসে সাহায্য করেছেন তাতে তিনি আপ্লুত। পাশাপাশি তাঁর বন্ধুবান্ধব, প্রাক্তন সহকর্মী থেকে শুরু করে পরিচিত সকলেই নিজেদের মতো করে আন্তনকে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তবে আন্তন জানেন, তাঁর এখনও অনেকখানি পথ চলা বাকি।

কলকাতাকে একটি স্মার্ট ফুড সিটি হিসেবে দেখতে চান তিনি। যেখানে প্রত্যেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়িতে তৈরী স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে পিছপা হবেন না। এই প্রযুক্তির সাহায্যেই কাজের সন্ধানে রোজ বিভিন্ন সংস্থার দরজায় ঘুরতে থাকা বহু মানুষ জীবিকার সন্ধান পাবেন। আন্তন বিশ্বাস করেন, "যেকোনও সমস্যা থেকেই সুযোগ আসে।" ফলে কাজের সুযোগ পেতে গেলে সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। আর তার সমাধানের পথে এগনোর চেষ্টা করতে হবে।" বিজনেস মডেল তৈরী করার আগে, সমস্যার সমাধানের কথা ভাবুন, তাহলেই নতুন উদ্যোগ গড়ে উঠবে" বলছেন তিনি।

"তবে সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না। প্রথম সুযোগকেই যাঁরা কাজে লাগাত পারেন, সেই উদ্যোগপতিরাই কিন্তু সফল হন," সব শেষে জানালেন ফ্লেক্সিমিল-এর কর্ণধার।