শান্তিময়ের হলুদচাষে পুরুলিয়ায়ও সবুজ সিগন্যাল
খরাপ্রবণ পুরুলিয়ায় এখন শান্তিময়ের হলুদ চাষের কথা মুখে মুখে ফিরছে। কারণ এখানে ধান রোয়ার পর খোদ প্রকৃতি লাভ-ক্ষতির হিসেবটা দেখে নেন। এই একপেশে লড়াইয়ে ক্রমাগত হেরে যাওয়াটা মানতে পারছিলেন না বাঁকুড়া ২ নম্বর ব্লকের প্রান্তিক চাষী শান্তিময় রানা। সেচহীন জমিকে বাগে আনতে হলুদ চাষ শুরু করেন তিনি। ব্যবহার করেন জৈবসার। তাতেই ম্যাজিক। শান্তিময়ের সামান্য জমিতে ঘটে গিয়েছে হলুদ বিপ্লব। ফলন হচ্ছে কয়েক কুইন্টাল।
শান্তিময়ের বাড়িতে হলুদ নেওয়ার জন্য পাড়ার দোকানদার থেকে বাইরের ব্যবসায়ীদের হুড়োহুড়ি। হলুদের মহিমা বুঝতে পেরে ওই ব্লকের বহু কৃষক এখন হলুদ চাষে নেমে পড়েছেন। পাশের জেলা পুরুলিয়াতেও শান্তিময়ের হলুদে হলুদ।
মাত্র ১৬ কাঠা জমি। ধান চাষ করলে কোনও বছর হাসি, কখনও হতাশা। শান্তিময় খুঁজছিলেন অন্য পথ। ২০১২-য় খবর পেলেন হলুদ চাষ নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ শিবির হচ্ছে ছাতনায়। তড়িঘড়ি সেখানে পৌঁছে গুরুগম্ভীর আলোচনার মধ্যে পেয়ে গেলেন তাঁর ইউ এস পি। বাঁকুড়ার মানকানালির এই বাসিন্দা স্থির করে ফেলেন হলুদ চাষই করবেন। আরও জানতে তিনি ঘুরতে থাকেন একের পর এক প্রশিক্ষণ শিবির। জমিতে বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য হাপা বা চৌবাচ্চা বানিয়েছিলেন। আর সার হিসাবে বাড়ির গোবরই ব্যবহার করছিলেন। তাতেই অসাধ্যসাধন। মাত্র ১৬ কাঠা জমিতে হলুদের ফলন হল ২৪ কুইন্ট্যাল । যেখানে কোনও গাছে গড়ে ৫০০ গ্রাম হলুদ হয়, সেখানে শান্তিময়ের এক একটা গাছ বা ঝাড়ে হলুদ ফলল ৮০০-৯০০ গ্রাম।
শুরুতেই এমন জাদু দেখানোর পর থেমে থাকেননি মানাকানালির এ কৃষক। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ৰশিক্ষণ শিবিরে শিখে নিলেন হলুদ প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টিও। তাই হলুদের প্রচুর ফলন হওয়ার পর প্রসেসিং-এর ব্যাপারে তাঁকে নতুন করে ভাবতে হয়নি।
স্ত্রী, দুই ছেলে ও মা-কে নিয়ে কাঁচা হলুদ থেকে গুঁড়ো হলুদ বানানো শুরু হয়। তাঁর বাড়ি এখন কার্যত হয়ে উঠেছে কুটির শিল্পের ঠিকানা।
বিশুদ্ধ হলুদের গন্ধ ও রং-এর খোঁজ পেয়ে এলাকার ব্যবসায়ীরা শান্তিময়ের বাড়ি থেকেই হলুদ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আসছেন রেশম চাষিরাও। এমনকি বাইরের ব্যবসায়ীরাও ঢুঁ মারছেন। এই আকাশছোঁয়া চাহিদা মেটাতে হলে সংগঠিতভাবে আরও অনেক কিছু করতে হবে। সেটা বুঝতে পেরেছেন শান্তিময়। তাই নতুন করে এবার ৮ বিঘা জমি লিজ নিয়েছেন।
এই উদ্যোগের শুরুর দিকে বিশেষ একটা আমল দেয়নি এলাকার অন্য চাষীরা। শান্তিময়ের সাফল্যে প্রাণ পেয়েছেন তাঁরাও। অনেকেই হলুদ চাষ শুরু করেছেন। শান্তিময়বাবুর কথায়, ‘‘আমি প্রতিবেশীদের জানিয়েছি ওরা যে হলুদ তৈরি করবে, তার বিক্রি নিয়ে একদম ভাবতে হবে না। আমিই হলুদ কিনে নেব।’’ উদ্যোগপতির মতো শোনায় তাঁর গলা।
চাষ করে থেমে থাকা নয়, শান্তিময় জানেন হলুদ বীজ সংরক্ষণ করতে পারলে লাভ সকলের। তার জন্য হলুদ বীজ সংরক্ষণ শুরু করে দিয়েছেন। শান্তিময়ের সঞ্চিত বীজ চলে যাচ্ছে পাশের জেলা পুরুলিয়ার নানা প্রান্তে। এক মরসুমে প্রায় ৫০ হাজার টাকা হলুদ বিক্রি করেছেন শান্তিময়।
৪২ বছরের মানুষটির কথায়, ‘‘বাজার নিয়ে চিন্তা নেই। হলুদ দিয়ে পারছি না। আরও চাষের এলাকা বাড়াতে হবে।’’ সাফল্যের সরণিতে থাকলেও অতীতকে ভোলেননি শান্তিময়। আরও শান্তিময় গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় তিনি স্বপ্ন ফেরি করতে শুরু করেছেন। সেমিনারে গিয়ে সহজ-সরলভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন হলুদ চাষের কৌশল। আর এভাবেই দুই জেলার কয়েকশো মানুষের জীবন তাঁর সৌজন্যে বদলে গিয়েছে। এখন লাভের টাকায় কেউ খড়ের চালার বাড়িতে টিন দিতে পেরেছেন। কেউবা রঙিন টিভি কিনেছেন, কেউবা বাড়তি টাকা জমিয়ে আরও জমিতে হলুদ চাষ করার পরিকল্পনা নিয়েছেন।