ভাঙা ঘর, ছিরিছাঁদ নেই। মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে, ঠোঙা বানিয়ে যা পান তাতেই চারজনের সংসারে অন্নসংস্থান। দু একবেলা উপোস অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। এত অনটনেও, দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটলো কী জুটলো না, তবু থেমে নেই মেয়েটি। ঘরে দৌড়, বাইরে দৌড়, মাঠে দৌড়। দৌড়েই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে শিখা মণ্ডল। মালদা শহরের অদূরে নঘরিয়া গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের এই মেয়ের নাম জেলা ছাপিয়ে রাজ্যের ক্রীড়া মহলেও ঢুকে পড়েছে। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই জেলার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়ে রাজ্য ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনুর্ধ্ব ১৫-র শিরোপা দখল করেছে সে।
বাবা ঠাকুরদাস মণ্ডল ভ্যান চালাতেন। বছর কয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন মা কাঞ্চনাদেবী। বাড়ি বাড়ি কাজ করে সন্তানদের মুখে দুবেলা দুমুঠোর জোগান দিতে হিমশিম খান। মেয়ে শিখা মায়ের সঙ্গেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে, ঠোঙা বানায়। আর সঙ্গে চলে দৌড়ের কঠোর অনুশীলন। ফাঁকি নেই পড়াশোনাতেও। নঘরিয়া হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী শিখা। স্বপ্ন পি টি ঊষা হবে একদিন। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে শুধু স্বপ্ন দেখে না শিখা, স্বপ্ন ছোঁয়ার দিকে এক ধাপ এক ধাপ করে এগিয়েও যাচ্ছে। দৌড় এবং লং জাম্পে ইতিমধ্যে জেলা স্তরে অনূর্ধ্ব ১৫র শিরোপা ঘরে ঢুকে পড়েছে। ডাক পড়েছে জুন মাসে পূর্বাঞ্চল ওপেন অ্যাথলেটিক্সের জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়।
খেলাধুলায় শিখার আগ্রহ আগেই স্কুলের শিক্ষকদের নজরে পড়েছিল। এই স্কুলেরই শিক্ষক পুলক ঝা ছাত্রছাত্রীদের খেলাধুলায় উৎসাহ দেন। শিখাকে ছোটবেলা থেকে দেখছেন। ‘ওর অধ্যবসায় দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এই মেয়ে লম্বা রেসের ঘোড়া’, বলছিলেন নঘরিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক পুলকবাবু। অ্যাথলিট হয়ে ওঠার জন্য যা যা দরকার তার নুন্যতম প্রয়োজনও মেটাতে পারেন না শিখার হতদরিদ্র মা। শুধুমাত্র অভাবের কারণে এমন সম্ভবনা হারিয়ে যাবে মানতে পারেননি পুলকবাবু। প্রিয় ছাত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ‘আমি দীর্ঘদিন স্কুলের পড়ুয়াদের নিয়ে খেলাধুলায় জীবন কাটিয়েছি। শিখাকে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। কী অসম্ভব নিষ্ঠা আর অধ্যবসায়। ওকে দেখে শিখতে হয়। ছেঁড়া জুতো পায়ে মাইলের পর মাইল দৌড়ে যায়। মুখে কষ্টের লেশমাত্র দেখি না। ওই অবস্থাতেই অনুশীলন করে জেলার অ্যাথলিটে শিখাই এখন শীর্ষে। ২০১৫র জুন থেকে ২০১৬র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫০০, ৪০০মিটার দৌড় এবং লং জাম্পে জেলা ও রাজ্যস্তরের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সাফল্যের মুকুট শিখার মাথায় উঠেছে। জুনে সল্টলেক স্টেডিয়ামে জাতীয় স্তরের ওপেন অ্যাথলেটিক্স মিটে শিখার ডাক পড়েছে’, বলছিলেন ছাত্রীর সাফল্যে গর্বিত পুলকস্যার।
‘ঠিক মতো খাবার দিতে পারি না। দৌড়বে, তার জন্য দামী জুতো দিতে পারি না। ছেঁড়া জুতো নিয়েই প্র্যাকটিস করে। দেখে কষ্ট পাই, কিছু করার সামর্থ নেই আমার। শিক্ষকদের মুখে, পাড়া প্রতিবেশীর মুখে ওর সাফল্যের কথা শুনে গর্ব হয়। মেয়ে আমার একদিন দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে’, কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বলেন অভাবী মা।
শিখার লক্ষ্য কী? ‘জাতীয় স্তরে একটা খেতাব জেতাই এখন আমার চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে আমি পিটি উষার মতো দৌড়বিদ হতে চাই’, কঠিন চোয়ালে অনুশীলনের ফাঁকে সংক্ষিপ্ত উত্তর শিখার। পি টি উষা হওয়ার স্বপ্ন দেখে শিখা। মিলখা সিংয়ের মতো উড়ে যেতে চায় মালদার প্রত্যন্ত নঘরিয়া গ্রামের ছিপছিপে গড়নের দারিদ্রক্লিষ্ট এই চতুর্দশী। ‘পি টি উষা বা মিলখা সিংকে আপনারা টিভির পর্দায় দেখেছেন। আমাদের শিখাও দেশকে সেই স্বপ্ন আরও একবার দেখাতে পারে। আগামীতে ও দেশের গর্ব হয়ে উঠবে’, প্রিয় ছাত্রীই যে তাঁর সেরা বাজি, বুঝিয়ে দিলেন মাস্টারমশাই পুলক ঝা।