অন্য এক 'সবুজ বিপ্লব' ঘটাতে চান রিয়া
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, সঠিক জীবনযাত্রা, সুস্বাস্থ্য - এসবই আজকাল আমাদের সর্বক্ষণের চর্চার বিষয়। আমরা সব সময়ই, কী খাওয়া উচিত, কী খাওয়া উচিত নয়, সেবিষয়ে আলোচনা করি। কিন্তু একবারও ভাবি না, যে পাত্রে খাবার খাচ্ছি বা রাখছি তার কথা। 'অপরিস্কার পাত্রে রাখা হলে, একই পাত্র বারবার ব্যবহার করা হলে অথবা খাবার রাখার জন্য ব্যবহৃত পাত্র তৈরির সময় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হলে যেকোনও সুষম খাদ্যের সম্পূর্ণ পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।', এমনটাই মনে করেন রিয়া সিংহল।
২০০৯ সালে 'ইকোওয়্যার সলিউশন্স'-এর প্রতিষ্ঠা করেন রিয়া সিংহল। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে খাবারের প্যাকেজিং করাই ছিল উদ্দেশ্য। যেভাবে পরিবেশবান্ধব জিনিসপত্র ব্যবহার করে ফেলে দিলেও তা সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যায়, ঠিক তেমন উপকরণ দিয়ে খাবারের প্যাকেজিংয়ের কথা ভাবছিলেন রিয়া। সেখান থেকেই স্টার্ট আপের ভাবনা শুরু। বেশ কিছুদিনের পড়াশুনো এবং ভাবনাচিন্তার পর তিনি এমন এক প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারলেন, যাতে যেকোনও ধরণের খাবার রাখা যায়। ২০১০ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে 'ইকোওয়্যার'।
প্রথমে গাছের অবশিষ্ট থেকে জৈব পদ্ধতিতে মণ্ড তৈরি করা হয়। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়েই। এরপর তৈরি হয় খাবার রাখার পাত্র। রিয়া সিংহলের মতে, 'ইকোওয়্যারের জিনিস একশো শতাংশ সুরক্ষিত। এইসব খাবার রাখার পাত্র গঠনগতভাবে মজবুত, জল প্রতিরোধকারী এবং দেখতেও সুন্দর- যা দৈনন্দিন জীবনে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়।'
USDA (United States Department of Agriculture)-র দেওয়া শংসাপত্র ইকোওয়্যার-এর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়েছে। অনলাইন এবং অফলাইন, দু'ক্ষেত্রেই 'ইকোওয়্যার'-এর জিনিস পাওয়া যায়। এখন দুটি প্রোডাকশন ইউনিট এবং একশোজন কর্মচারীর সাহায্যে বছরে দশ কোটি টাকার ব্যবসা করে এই সংস্থা। ভারতের পাশাপাশি ব্যবসার পরিধি ছড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং আরবের দেশগুলিতেও। মাত্র কয়েক বছরে নিজের সংস্থাকে এই জায়গায় নিয়ে যাওয়া রিয়ার কাছে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার না করে মানুষ কেন এধরণের জিনিস কিনবেন, তা বোঝানো সহজ কাজ ছিল না। ছোট থেকে বড় সকলকে এবিষয়ে সচেতন করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ করতে হয় রিয়া সিংহলকে। বিভিন্ন স্কুলে সচেতনতা শিবিরের আয়েজন থেকে শুরু করে ক্যান্সার সাপোর্ট গ্রুপের সহায়তায় প্লাস্টিক এবং স্টাইরোফোমের ক্ষতিকর দিকগুলি মানুষের কাছে তুলে ধরা। চেষ্টার কসুর করেননি রিয়া। মানুষের কাছে 'ইকোওয়্যার'-কে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মতোই কঠিন ছিল উদ্যোগপতি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। কারখানার শ্রমিক থেকে বাজারের বিক্রেতা,পুরুষ শাসিত শিল্পক্ষেত্রে পায়ের তলার জমি শক্ত করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁকে।
তাঁর সাফল্যের পিছনে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে রিয়ার ছোটবেলার। ১৯৮৩ সালে রিয়ার যখন মাত্র এক বছর বয়স সেই সময় তাঁকে নিয়ে দুবাই চলে যান বাবা,মা। এরপর রিয়া সিংহলের বেড়ে ওঠা দুবাই এবং লন্ডনে। ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিস্টল থেকে ফার্মাকোলজিতে স্নাতক হওয়ার পর মার্কিন সংস্থা ফিজারে সিনিয়র মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস একজিকিউটিভ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন রিয়া। পাঁচ বছর সেখানে কাজ করতে করতেই রিয়া উপলব্ধি করেন, 'পরিবর্তনই জগতের নিয়ম। যা মানুষের হাতে নেই তা নিয়ে অযথা ভেবে সময় নষ্ট করার কোনও কারণ নেই।' সব ভুলে শুধু নিজের কাজকেই আপন করে নিতে শেখেন তিনি। ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বামীর সঙ্গে দিল্লি চলে আসেন রিয়া সিংহল। সেখানেই প্রথম মানুষের খাদ্যাভ্যাস দেখে এবং যেসব পাত্রে খাবার পরিবেশন করা হয় তা দেখে নতুন কিছু করার কথা মাথায় আসে তাঁর। সেই ভাবনাচিন্তা থেকেই ধীরে ধীরে জন্ম নেয় 'ইকোওয়্যার'।
পুরোপুরি নিজের উদ্যমেই কাজ শুরু করেছিলেন রিয়া। যদিও আজ তাঁর পরিবার এবং সংস্থা দুয়েরই পরিধি বেড়েছে। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে 'ইকোওয়্যার সলিউশন্স'-এ যোগ দেন রিয়ার স্বামীও। রিয়া এখন তাঁর সংস্থার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, সেলস, মার্কেটিং এবং ব্র্যান্ডিংয়ের-এর দায়িত্ব সামলান। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে কাজ করলেও কেউ কারও বিষয়ে নেহাত প্রয়োজন না হলে হস্তক্ষেপ করেন না। কাজের বিষয়ে শুধু অফিসেই কথা বলতে পছন্দ করেন তিনি। কারণ বাড়িতে রিয়া সিংহল তাঁর পুরো সময়টা তুলে রাখেন পরিবার আর সন্তানদের জন্য।
সমস্ত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে চলা, সবধরনের মানুষ এবং তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, এবং যেকোনও সমস্যার সমাধান খুঁজতে শেখা, এটাই রিয়ার এবং তাঁর ব্যবসার বড় হওয়ার মূলমন্ত্র। রিয়া সিংহল চান ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁ হোক, বা রাস্তার ধারের চায়ের দোকান, সকলেই যেন তাঁর সংস্থার তৈরি পরিবেশবান্ধব জিনিস ব্যবহার করতে পারেন। ঠিক যেভাবে স্বাস্থ্য সচেতনার ক্ষেত্রে ডেটল এবং অনলাইনের সার্চের জন্য গুগল অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, সেভাবেই খাদ্য পরিবেশনের জন্য ঘরে ঘরে 'ইকোওয়্যার'-কে পৌঁছে দেওয়াই রিয়ার স্বপ্ন।