কলকাতার যে স্টার্টআপ-এ মজে ছিলেন নেতাজি
ভীষণ গরম, গলা ভেজাবেন? ১৯১৮ থেকে কলকাতার তেষ্টা মেটাচ্ছে ‘প্যারামাউন্ট’। কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়ার পিছন দিকে, মহাবোধি সোসাইটির পাশেই সরবত আর সিরাপের এই দোকান সবাই চেনে। আপনি যদি প্রথম শুনছেন এই নাম তাহলে জানবেন এই গরমে প্যারামাউন্টেরই মরিচীকা দেখে কলকাতা।
১৯১৮ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে টালমাটাল দুনিয়া। গরম দেশের রাজনীতি। এরকম গরমেই নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর তেষ্টা মিটিয়েছিল প্যারামাউন্ট। শুধু কি নেতাজি। লম্বা তালিকা।প্যারামাউন্টে ঢুকলে চোখে পড়বে লম্বা এই সেলেব্রিটি-লিস্ট। কিছু নাম ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে। তাতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন মেঘনাদ সাহা, সত্যেন রায়, জগদীশ চন্দ্র বসু। আছেন প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বিপ্লবী সতীন সেন, বিপ্লবী মানবেন্দ্র রায়, কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে কল্লোল উৎরনো কবি শঙ্খ ঘোষ। লেখিকা নবনীতা দেবসেন। বিতর্কিত তসলিমা নাসরিন। রাষ্ট্রের চক্ষুশূল অরুন্ধতি রায়। কে নেই! আছেন হাই ভোল্টেজ অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনও। সবাই যেন জীবন্ত এই সরবতে।
ডাব সরবতে গলা ভিজিয়েছেন এই সব স্পেশাল মানুষ। প্যারামাউন্টের স্পেশাল ডাব সরবত। শুধু সরবত তো নয়। এক চুমুকে ঘুরে আসুন সংস্কৃতির শিকড়ে৷ এখানে সরবত মানে শুধু পানীয় নয়। এখানে সরবত মানে পরতে পরতে ইতিহাস। এখানে সরবত মানে আতিথেয়তা৷ ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ‘প্যারামাউন্ট’।
বরিশাল থেকে কলকাতায় এসে নীহাররঞ্জন মজুমদার ১৯১৮ সালে এই দোকানটি তৈরি করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে এ দোকানের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। নীহারবাবু নিজে বরিশাল অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। কলেজ স্কোয়ারে আজকের প্যারামাউন্ট সরবতের দোকানঘরটি ছিল তখন সমিতির গোপন কেন্দ্র। প্রথমে দোকানের নাম ছিল ‘প্যারাডাইস’। শহরে সরবতের ঠিকানা। সঙ্গে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা।
সাল ১৯৩৮, ‘প্যারাডাইস’ হল ‘প্যারামাউন্ট’। কয়েক দশক পেরিয়েও কলেজ স্কোয়্যারে তিন প্রজন্মের ‘প্যারামাউন্ট’ সরবতের দোকানঘর আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছে। সরবতের টানে আজও ভিড় জমাচ্ছেন আট থেকে আশি। ছোট্ট দোকানে একসঙ্গে ২০ জনের মত বসার ব্যবস্থা। আজও এসি নেই, মাথার ওপরে লম্বা রডের ইলেকট্রিক ফ্যান। গদি-আঁটা চেয়ার নয়, বেঞ্চ ও টেবিল। টেবিলের ওপরে সে সময়ের ইটালিয়ান মার্বেল। যার দাম ছিল তখন মাত্র আট টাকা। দোকানের দেওয়ালে হরিণের শিং। হায়দরাবাদের নিজাম থেকে নিলামে সেসময় আশি টাকা দিয়ে কিনেছিলেন নীহাররঞ্জন। বসার জায়গা না থাকলে, চাইলে বোতলে সরবত বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। এমনকি বিয়ে সহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে প্যারামাউন্ট সরবত পরিবেশন করে থাকে।
কী কী সরবত এখানে এখন পাওয়া যায়? মূলত তিন রকম সরবত পাওয়া যায় এখানে। স্পেশাল ড্রিঙ্ক, ক্রিম বেসড ড্রিঙ্ক আর সিরাপ। স্পেশাল ড্রিঙ্কের মধ্যে পাওয়া যায় ডাব সরবত, প্যাশন ফ্রুট, কোকো মালাই, পাইন্যাপেল মালাই, স্ট্রবেরি মালাই, রোজ মালাই, ভ্যানিলা মালাই, গ্রেপস ক্রাশ আর কোল্ড কফি। ক্রিম বেসড ড্রিঙ্কের মধ্যে রোজ, ব্যানানা, লেমন, অরেঞ্জ, পাইন্যাপেল, গ্রিন ম্যাঙ্গো, ভ্যানিলা উল্লেখযোগ্য। সিরাপের মধ্যে পাওয়া যায় - রোজ, লেমন, অরেঞ্জ, গ্রিন ম্যাঙ্গো, লিচু এমনকি ট্যামারিন্ড বা তেঁতুলের সিরাপও।
এতো বছর পেরিয়ে এখনও প্যারামাউন্টের সুপারহিট আইটেম ডাব সরবত। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের রেসিপিতে তা তৈরি। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় তখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পার্ট টাইম লেকচারার ছিলেন। ছিলেন নীহারবাবুর অত্যন্ত কাছের মানুষও৷ কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাই অধিকাংশ সময় সরবত খেতে আসতেন এই দোকানে. পড়ুয়াদের কথা মাথায় রেখেই আচার্য পি সি রায় নীহারবাবুকে বলেন, ‘নীহার এমন একটা সরবত তৈরি কর, যা খেয়ে তৃষ্ণাও মিটবে, আবার পেটও ভরবে৷ ছেলেরা জলটা খাওয়ার পরে শাঁসে ফুড ভ্যালু আছে, ওটিও খেয়ে নেবে।’ ডাবের জল, শাঁস এবং সিরাপ দিয়ে তৈরি হল ডাব সরবত। দোকানে বসে ডাব সরবতের ইতিহাস বলতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন নীহারবাবুর নাতি পার্থপ্রতিম মজুমদার। পার্থপ্রতিমবাবু আরও জানান, ‘ডাবের সরবতের পাশাপাশি সম্পূর্ন রাবড়ি দিয়ে তৈরি ‘প্যাশন ফ্রুটস’, ‘কোকো মালাই’ এবং সিরাপের মধ্যে ‘ট্যামারিন্ড সিরাপ’-এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ জলজিরা দিয়ে তেঁতুলের সরবত। “গরমে সবাই ওটা খেতে চায়,” জানালেন নীহারবাবুর উত্তরপুরুষ।
দেখা হল মৃগেন্দ মজুমদার সকলের সোনা মামার সঙ্গে। অমায়িক মানুষ এই সোনা মামা। বলছিলেন এই দোকান আমাদের গোটা পরিবারের। তাই গোটা পরিবারই বুক দিয়ে আগলে রেখেছি। সোনা মামার ভাগ্নে কৌশিক মজুমদার ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। মূলত জনসংযোগ সামাল দেন তিনি। সাহিত্যের অনুরাগ ওঁর ইমেল ঠিকানা দেখেই টের পাওয়া যায়। কিটস ওয়ার্ডসওয়ার্থের নাম দিয়ে বানিয়েছেন ইমেল। বলছিলেন, "খস, চন্দন, ম্যাঙ্গোলিয়ার মতো বিখ্যাত সরবতের চল বর্তমানে কমেছে। নতুন প্রজন্মের চাহিদার তালিকায় উঠে এসেছে কোল্ড কফি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আধুনিক করেছি আমরা। কিন্তু ঐতিহ্য আর বৈশিষ্ঠ ভুলে যাইনি। তাই আমরা কিন্তু মেশিনে কোল্ড কফি তৈরি করি না। ঠান্ডা দুধে মালাই দিয়ে, কফিটা হাতে তৈরি করি।” গুনগতমান বজায় রাখাই মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়লেও কোয়ালিটি কন্ট্রোলই key ফ্যাক্টর। সিরাপ ও সরবতের দাম ৪০ টাকা থেকে শুরু। আপনার সাধ্যসীমার মধ্যেই। রাবড়ি দিয়ে কাজু, পেস্তা মিশিয়ে প্যাশন ফ্রুটের সরবত সবচেয়ে দামি।
১৯৭৯ সালে নীহারবাবুর মৃত্যুর পরেও মজুমদার পরিবারের সকলে মিলে এই সরবত প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন। মুখেমুখে ছড়ানো ইতিহাসই ওঁদের অন্যতম অবলম্বন, “আমরা কোথাও বিজ্ঞাপন দিই না, দরকারও হয় না,” বলছিলেন, নীহারবাবুর উত্তরপুরুষরা। ব্র্যান্ডিং, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট জাতীয় কোনও গম্ভীর শব্দ নয়। ইতিহাস,পারিবারিক, আতিথেয়তা এবং ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে বাঙালির নিজস্ব এক ‘বিজনেস মডেল’ এই প্যারামাউন্ট।