কিপলিংয়ের মোগলি, কলকাতার পারবিতা

কিপলিংয়ের মোগলি, কলকাতার পারবিতা

Sunday March 20, 2016,

4 min Read

একে মেয়ে, তার উপর বনজঙ্গল। বনজঙ্গলও আবার যে সে নয়। বাঘসিংহ উপদ্রুত এবং বিপদসঙ্কুল। সেখানেই অকুতোভয়ে ঘুরে বেড়ান কলকাতার এক বাঙালি মেয়ে। মেয়েটির নাম পারবিতা বসু। পেশায় তিনি এনভায়রনমেন্টাল বায়োলজিস্ট।

image


কলকাতার একটি বাংলা মাধ্যম মেয়েদের স্কুলে পড়েছেন। বরাবর লেখাপড়ায় মেধাবী। বেথুন কলেজ থেকে জুলজিতে স্নাতক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরে পিএইচডি করেছেন দেরাদুনের ওয়াইল্ড লাইফ ইন্সটিটিউশন থেকে। কিন্তু ঠিক কোন কাজটা করেন পারবিতা, তা জানতে চাইলে সপ্রতিভ ভাবে হাসতে হাসতে ও জানায়, এ দেশের কোন জঙ্গলে কী পরিমাণ বাঘসিংহ আছে, তা গুনে হদিশ করে বেড়ানোই ওঁর প্রধান কাজ। মনে পড়ে গেল শের খান বনাম মোগলির লড়াই। রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের মোগলির কথা মনে পড়ে গেল। যে জঙ্গলকে নিজের ঘর ভাবত। মানুষের সন্তান হয়েও পশুপাখির আত্মীয় হয়ে গিয়েছিল সেই শিশুটির কথা মনে পড়ে গেল। কলকাতার মেয়ে পারবিতাও জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। জঙ্গলের পশুপাখির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারেন। রীতিমত আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে পারবিতার। তাই জঙ্গলে ভয় করে না মেয়েটার। ও দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছা করলেই মেয়েরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেন। এজন্য প্রয়োজন প্যাশান, সুযোগ আর উচ্চশিক্ষা।

না, খুব একটা ডানপিটে কখনও ছিলেন না পারবিতা। স্কুলে ও কলেজে পড়ার সময়ও সাহিত্য ছিল তাঁর শখের অন্যতম বিষয়। পারবিতা বললেন, কবিতা লিখতাম। স্কুল বা কলেজ ম্যাগাজিনে ওই গল্পকবিতা ছাপাতাম। নিজের লেখা প্রকাশিত হলে বেশ রোমাঞ্চিত হতাম। এখনও সময় পেলে কবিতা লিখি। বাঘসিংহ নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেন যে মেয়ে কবি হিসাবে তাঁকে মানায় কিনা সেও এক তর্কের বিষয়। তবে পারবিতার কাছে ব্যাপারটা মোটেও তর্কের নয় । বরং, এ যেন অনেকটা তর্কে বহুদূরের মতো এক জিনিস! এ‌মনকি, বাঘসিংহ নিয়েও একগুচ্ছ কবিতা রয়েছে পারবিতার।

পারবিতার পেশাটা অফবিট। সচরাচর এই কাজটা পুরুষরাই করে করে অভ্যস্ত। পারবিতা বলছিলেন, লোকসংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তাই মানুষ জঙ্গল কাটছে আর সেখানে গড়ে তুলছে খেত খামার। ফলে যে বাঘসিংহ বনজঙ্গলে অবাধভাবে ঘুরে বেড়াত, মানুষের প্রয়োজনে তাদের বিচরণ ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। মূলত এই বিষয়টি নিয়েই গবেষণার কাজ করছেন পারবিতা। এজন্য তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হয় বনেজঙ্গলে অথবা জঙ্গল ঘেঁষা গ্রামগুলিতে। আর বুঝে নিতে হয় বনে সুন্দর বাঘসিংহের ভবিষ্যতের হিসাবটা।

২০০৭ সালে পারবিতা দেরাদুনের ওয়াইল্ড লাইফ ইন্সটিটিউটে ডক্টরেট করার জন্যে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর ক্রমাণ্বয়ে কেটে গিয়েছে আটটি বছর। পারবিতা কাজের ক্ষেত্রে আরও পরিণত হয়েছেন। বললেন, একাজে মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি অনেক। পিএইচডি করার সময় একা একা ঘুরে বেড়াতে হত বনাঞ্চলে। বনাঞ্চল সংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দারা একা একটি মেয়েকে বিপজ্জনক কাজ করতে দেখে অবাক হতেন খুবই। সৌরাষ্ট্রে সিংহ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এমন পরিস্থিতিতে বারংবার পড়তে হয়েছে। সেইসঙ্গে পেয়েছি প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামবাসীদের সহায়তা। ওঁরা রাতে আশ্রয় দিয়েছেন। তাছাড়া, আতিথ্যের কোনওরকম ত্রুটি রাখেননি। ওই অভিজ্ঞতা আমায় অভিভূত করেছে।

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে উল্লেখ করার মতো আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন পারবিতা। সিনিয়র রিসার্চ বায়ো‌লজিস্ট হিসাবে ৭০জনের একটি গবেষক দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ওই গবেষক দলটির মুখ্য কাজ ছিল দেশজুড়ে নানান বনাঞ্চলের ব্যাঘ্র গণনা। পাশাপাশি, সৌরাষ্ট্রের বনাঞ্চলে সিংহগণনার কাজটিও সেইসময় করছিলেন ওঁরা।

বিপদ! বিপদকে চ্যালেঞ্জ না করতে পারাই তো সব থেকে বড় বিপদ। মেয়ে হিসাবে বরাবর বিপদকে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছা ছিল ওর। ওই শখটা ক্রমে পেশা হয়ে গেল। তাতে ও খুশি।
image


তবে অভিভাবকেরা একসময় পারবিতাকে নিয়ে বেজায় চিন্তিত ছিলেন । কারণ পারবিতা ঠিক কী করতে চাইছেন, অভিভাবকদের গতানুগতিক মানসিকতায় সে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল না। পারবিতা হেসে জানালেন, ওঁরা এখন খানিকটা হলেও আমার কাজটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছেন। একটা সময় ওঁরা ভাবতে পারতেন না ঘরের মেয়ে বনেজঙ্গলে গিয়ে কোন রাজকার্যটা করবে!

পারবিতার কাছে ওঁর কাজ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানতে চাই। উত্তরে পারবিতা জানালেন, গত ৯ বছর ধরে আমি কাজ করছি ন্যাশনাল রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ল্যান্ডস্কেপ ইকোলজি, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডপশন বা বাঘসিংহ সংরক্ষণের মতো বিষয়গুলি নিয়ে। এজন্য গবেষক হিসাবে ঘুরে ঘুরে কাজ করতে হয়েছে গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, তামিলনাড়ু-সহ ভারতের একাধিক রাজ্যের বনাঞ্চলে।

বৈজ্ঞানিক হিসাবে আরও পথ চলতে চান। চলার পথে অনেক অনাত্মীয়ও পারবিতাকে যথাসাধ্য সহায়তা করেছেন। সেই অনাত্মীয় মানুষগুলি এদেশের অজ্ঞ গ্রামবাসী। যারা আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন আর পারবিতার বীরত্ব আর সাহসকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। আর পারবিতাও ওদের ভরসাতেই এদেশের বনেবনান্তরে ঘুরে বেড়ান। ৩৩ বছরের এই বাঙালি মেয়ে নিজের পেশায় আজ সফল। কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ইতিমধ্যেই কমনওয়েলথ প্রফেশনাল ফেলো হিসাবে সম্মানীত হয়েছেন। এছাড়াও লিডস ফেলো হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। মেয়ের কৃতিত্বে আজ বাবা-মাও গর্বিত। তবে ওরা জানেন একাজে বিপদ আছেই। কিন্তু সব থেকে সুখের কথা হল এপর্যন্ত তিনি কোনও বিপদে পড়েননি। 

শখের কবির মতো কবিতা করে পারবিতা বলছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। যার মৌলিক নির্যাস হল, বন্যেরা বনে সত্যিই সুন্দর!‍ দুচোখ ভরে দেখার মতো ওদের সরল সংসার।