"তিরের মতো তন্ময় হও" বলছেন তিরন্দাজ দোলা
দোলা বন্দোপাধ্যায়। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাংলার আর পাঁচটা আটপৌরে মেয়ের জীবন থেকে ওরটা একটু আলাদা। তিরন্দাজিতে নিখুঁত। সাফল্যের প্রতি লক্ষ্য স্থির। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে এই মেয়ে দেশের হয়ে বেশ কয়েকবার জয় ছিনিয়ে এনেছে। ওঁকে মোটিভেট করেছে ওঁর সাফল্যের নেশা। দেখুন তো কোনও ভাবে ও আপনাকে মটিভেট করতে পারে কিনা! দোলা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় দেবলীনা দত্ত মজুমদার।
আপনি সাফল্যকে কীভাবে দেখেন?
সত্যি সত্যি যদি মন থেকে কিছু করতে চাও তাহলে সেটা নিজেই নিজের রাস্তা তৈরি করে নেয়। শুধু একটাই কাজ তোমাকে করতে হয় সেটা হল চাইতে হয় মন দিয়ে। আর এই মন দিয়ে মানে তিরের মত তন্ময় একাগ্র হয়ে তোমাকে মনটা দিতে হবে। হাওয়ার বেগ মেপে, দূরত্ব মেপে তুমি লক্ষ্য স্থির করবে ধনুকের ছিলায় টান দেওয়া পর্যন্ত তোমার কাজ। বাকিটা ওই তন্ময় তির করে দেবে। যদি মাপজোক ঠিক থাকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তিরটা লাগবেই লক্ষ্যে।
আপনি তিরন্দাজিতে এলেন কী করে?
বরানগরের যৌথ পরিবার। সাধারণ মধ্যবিত্ত ব্যাকগ্রাউন্ড। আর পাঁচটা পরিবারের মত বাড়ির মেয়েকে পড়াশুনোর পাশাপাশি শেখানো হত গান। তবে আমার বাবা মা ছোটবেলা থেকেই চাইতেন কোনওরকম ফিজিক্যাল অ্যাকটিভিটির সঙ্গে যেন যুক্ত থাকি। বিকেলে পাড়ার মাঠে খেলতে যেতাম। সঙ্গে বাবা বা মা যেতেন। এই তো বাড়ির কাছেই বসাকবাগানের মাঠের একদিকেই চলত আর্চারি শেখার ক্লাস। তাঁরাই বাবাকে অনুরোধ করেন ভর্তি করিয়ে দিতে। সেখান থেকেই শুরু। ৯ বছর বয়সে ভর্তি হই। তবে শুরুর দিকে একদমই ভাল লাগত না। পালিয়েও আসতাম ক্লাস থেকে।
তাহলে কী করে বদলালো ছবি?
আরে সে এক দারুণ ব্যাপার। জোর করে শেখানো হলেও ভালই রপ্ত করে নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। ফলে ৮৯-৯০ সাল থেকেই রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে থাকি। আর পদকও পেতে শুরু করি। এই সাফল্যটাই আর্চারিকে ভালবাসতে শেখায়। নিয়মিতই প্রথম বা দ্বিতীয় হতাম। তাই আরও ভাল করার ইচ্ছাটা পেয়ে বসত। এরপরই পর্যায় মেনে জাতীয় স্তর, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক স্তর।
কোনও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি?
সে আবার হয়নি। আসলে আর্চারির ইকুয়ইপমেন্ট খুব দামি। আর তির, ধনুক দুইই বাইরে থেকে আনাতে হয়। নব্বইয়ের দশকে আমি যখন শুরু করি তখন বিষয়টা আরও জটিল ছিল। এখনকার মত অনলাইনে কোনও জিনিস অর্ডার করা যেত না। টুর্ণামেন্ট খেলতে বাইরে গেলে সেসব জায়গায় অর্ডার দিতে হত। তারওপর এই জিনিসগুলো আবার নিজের স্পেশিফিকেশন মতো বানাতে হত। ফলে অর্ডার দিয়ে চলে আসার বহু পরে জিনিস হাতে পেতাম। আর টাকা পয়সার বিষয়টাতো আছেই। বাবা চেষ্টা করতেন সাধ্যমত নিজের সেরাটা দেওয়ার। কিন্তু তাও। একবার একটা টুর্ণামেন্ট খেলতে গিয়ে বো ভেঙে গিয়েছিল। কী দুঃখ যে হয়েছিল আজও তা মনে আছে। তবে ১৯৯৭ সালে টাটায় চাকরি পাওয়ার পর অবস্থাটা ধীরে ধীরে বদলাতে লাগল।যদিও বাংলা ছাড়তে হল। তখনকার বিহার এখনকার ঝাড়খন্ডের হয়ে টুর্ণামেন্টে নামতে শুরু করলাম। এর পাশপাশি চলছিল পড়াশুনো। তবে নিয়মিত যাতায়াত করার জন্য গ্র্যাজুয়েশনের পর আর পড়াশুনো কন্টিনিউ করা যায়নি। ধীরে ধীরে পুরো সময়টাই নিয়ে নিল তিরন্দাজি।
সাফল্য বললেই কী কী মনে পড়ে?
সাবজুনিয়রে ৩ বার ও জুনিয়রে ২ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দটা দারুণ ছিল। ভারতসেরা হয়েছি। ২০০৫ সালে অর্জুন পাই। ইউরোপিয়ান গ্রাঁ প্রিতে সোনা জিতেছিলাম। ওর্য়াল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা সবই আছে আমার সাফল্যের তালিকায়। ২০১০ কমনওয়েলথেও দলগত ও ব্যক্তিগত বিভাগে পদক এসেছে। পরিবারও আমার সাফল্যের একটি জায়গা। পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার বাবা, মা খালি উৎসাহই দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ট্যুরে গিয়েছেন। ভাইও খুব সাহায্য করেছে। আর আমি খুব লাকি আমার নতুন জীবনেও। আমার স্বামী-শ্বশুর বাড়ি সবাই ভীষণ সার্পোটিভ।