হুইলচেয়ারে বসেই আকাশ ছুঁতে শিখেছে রায়গঞ্জের সনু
মা বলেছেন, রবিঠাকুর পড়লে নাকি মন ভালো হয়ে যায়। তাই একটু মন কেমন করলেই পাঠ্য বইয়ে রবি ঠাকুরের কবিতা আর গল্প খোঁজে সনু। আলাদা করে বই কিনতে পারবেন না বাবা। সনু জানে সে কথা, বোঝেও। আর জানে পরিবারের একমাত্র সন্তান সনুই বাবা-মায়ের স্বপ্ন। তাই শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে মাধ্যমিক পেরোনর পর সনুর পাখির চোখ এবার উচ্চমাধ্যমিক। ছোট ছোট স্পেলে বড় ইনিংস খেলতে চায় মহেন্দ্র সিং ধোনির এই ভাবশিষ্য।
জন্মের ৬ দিনের মাথায় জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন ডাক্তার। বলেছিলেন ৫ বছরও বাঁচানো মুশকিল হবে শরীরের থেকে বড় মাথার অদ্ভুতদর্শন ছোট্ট সনুকে। হাল ছাড়েননি বাবা বাবলু গুপ্ত। ডাক্তার বলেছিলেন মাথা থেকে জল বের করতে হবে।রাজি হননি বাবলুবাবু। এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল এই ডাক্তার সেই ডাক্তার ঘুরে নিজেই ঠিক করলেন, স্বাভাবিক বাচ্চার মতো ছেলে যেভাবে বড় হওয়ার হোক। সেই সনু মা যখন ছাত্র পড়াতেন চুপটি করে পাশে বসে থাকত। দাদা-দিদিদের সঙ্গে গলা মেলাতে মেলাতে পড়াটাও শিখতে থাকে। সনু যখন পাঁচ বছর বাবা-মা ঠিক করলেন ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবেন। চলাফেরার একমাত্র ভরসা হুইল চেয়ার। কিন্তু তা সত্ত্বেও আর পাঁচটা ছেলে মেয়েদের সঙ্গে সাধারন স্কুলেই পড়াশুনা করতে পাঠানো হয় সোনুকে। ‘যখন ছোট ছিলাম, প্রাইমারি স্কুলে মা নিয়ে যেতেন। হাইস্কুলে ওঠার পর বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতাম’, আধো আধো বুলিতে বলে চলে বছর বাইশের সনু।
মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোনর দিন সকাল থেকে চাপা টেনশন ছিল গুপ্ত পরিবারে। দুপুরে রেজাল্ট বেরোতে তবে স্বস্তি, ভালোভাবেই মাধ্যমিক পাশ করেছে বাড়ির একমাত্র ছেলে সোনু। যে কোনও বাড়ির খুব সাধারন এই দৃশ্য থেকে কিছুটা আলাদা রায়গঞ্জের মোহনবাটি হাইস্কুলের ছাত্র সোনু গুপ্তার গল্প। জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সনুর লড়াইয়ের একটা অধ্যা য় শেষ করল সে। ফল বেরোতেই বাবার সঙ্গে হুইলচেয়ারে চেপে সটান স্কুলে পৌঁছে যায়। বাবার কোলে চেপেই মার্কশিট সংগ্রহ করে আনন্দ চেপে রাখতে পারে না সনু। চোখ ভিজে গেল বাবার। আর সনুকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই স্কুলের মাস্টরমশাইদের।
এখানেই থেমে থাকতে চায় না সনু। এরইমধ্যে কম্পিউটারে সরগড় হয়ে গিয়েছে। ‘কম্পিউটারটা আরও ভালোভাবে শিখতে চাই। এগারো ক্লাসে ভর্তি হতে যাবো বাবার সঙ্গে। মাধ্যমিকটা ভালোভাবে পাশ করার পর মনের জোর বেড়ে গিয়েছে’, বলছিল সনু। কিন্তু বাবার রেস্তর জোর কোথায়? সামান্য মুদির দোকান চালিয়ে ছেলের পড়াশোনার এতটা খরচ জোগাতে পারবেন না বাবলু গুপ্ত। ‘দোকান থেকে যা আয় সংসারের খরচেই চলে যায়। ছেলেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ানোর টাকা পাবো কোথায়। সরকার বা কোনও সংস্থা অথবা কেউ যদি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে ছেলেটার পড়া চালিয়ে যেতে পারি’, চোখ মুছতে মুছতে বলেন বাবা বাবলু গুপ্ত।
ক্রিকেটভক্ত সনু গড়গড় করে বলে যায় ভারতীয় স্কোয়াডের ক্রিকেটারদের নাম। প্রথম পছন্দ ধোনি, তারপর বিরাট এবং সচিন। আর ভালোবাসে সিনেমা দেখতে। পছন্দের হিরোইন দিপীকা পাডুকোন। হুইলচেয়ারে বসেই স্বপ্ন বোনে সনু। ওই হুইলচেয়ারটাই আরও বেশি লড়াই করতে শিখিয়েছে গুপ্তা পরিবারের একমাত্র সন্তানকে। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে সে। সম্বল মনের জোর। জানে, ভবিষৎ লড়াইটা আরও কঠিন। তার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে। হেরে যাওয়া শব্দটা যে মানতে পারে না সনু ।