ভারতে স্টার্টআপের শুরুয়াতিকথা
বিশ্বায়নের দৌলতে দরজা খোলা। তাই ভারত এখন গোটা দুনিয়ার বাজার। ১২০ কোটি ক্রেতা। অনেক লড়াই দেখা বৃদ্ধা পৃথিবী এখন ব্র্যান্ডের লড়াই দেখছে। এয়ারটেল বনাম ভোডাফোন, কোক বনাম পেপসি, লি বনাম পেপে, গুগুল বনাম ফেসবুক। কিন্তু একটা সময় ছিল এই আজকের ভারতই ছিল ব্র্যান্ডের বাজারে সব থেকে বড় ব্র্যান্ড। ম্যানচেস্টারের যন্ত্রে বনানো কাপড়কে দুয়ো দিয়ে মসলিন বাজার মাত করে দিয়েছিল। তাকে রুখতে বণিকের মাণদণ্ড রাজদণ্ডে বদলে গিয়েছিল। সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল ব্র্যান্ড এবং পলিটিকস ওতোপ্রোতো ভাবে যুক্ত। একে অপরের পরিপূরক। এসবের মধ্যেও সমস্ত দুরভিসন্ধির মুখে ছাই দিয়ে সিপাহি বিদ্রোহের অব্যবহিত পরই একটি একক মানুষের প্রয়াস একটা ব্র্যান্ডের জন্ম দেয়। এই ভারতে। কতকটা কলকাতার অনুষঙ্গও আছে বৈকি। সেই ব্র্যান্ড আজও গর্বিত করে গোটা জাতিকে।
ভারতীয় মুদ্রায় তখনকার সময়ে মাত্র ২১ হাজার টাকা এবং বাবার ব্যবসার সাথে ৯ বছর যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে ২৯ বছরের এক যুবক ব্রিটিশ শাসিত ভারতে একটি ব্যবসায়িক সংস্থা তৈরি করে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি চিঞ্চপোকলিতে একটি দেউলিয়া হয়ে যাওয়া তেলের কোম্পানি কিনে সেখানে একটি কটন মিল তৈরি করেন। দুবছর পরে তিনি এই মিলটিকে লাভজনক মূল্যে বিক্রি করে দেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই নাগপুরে আরেকটি মিল তৈরি করেন। ব্রিটিশ ভারতের এই উদ্যোগপতির নাম জামসেদজী টাটা। ধীশক্তিতে উজ্জ্বল, দূরদর্শী এই ভারতীয় শিল্পপতিই হলেন আজকের গ্লোবাল এন্টারপ্রাইজ ‘দি টাটা গ্রুপ’ এর স্রষ্টা।
১. টাটা গোষ্ঠী- ১৮৬৮
জামসেদজী টাটার লক্ষ্য ছিল চারটি জিনিস তৈরি করা – একটি হাইড্রো ইলেকট্রিক প্লান্ট, একটি স্টিল প্লান্ট, একটি বিশ্বমানের শিক্ষাকেন্দ্র ও একটি বিশ্বমানের হোটেল। নিজের জীবদ্দশায় তিনি তাজমহল হোটেল নির্মান করতে সক্ষম হন। এবং তাঁর স্বপ্নকে সফল করে তাঁর উত্তরসূরীরা তাঁর নির্ধারিত অপর তিনটি লক্ষ্যকেও পূরণ করেন। সেইসময়ে তাজমহলই ছিল ভারতবর্ষের একমাত্র হোটেল যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। বর্তমানে একশটিরও বেশি দেশে টাটা গ্রুপ তার বিশাল কর্মকাণ্ড নিয়ে হাজির। দেড়শরও বেশি দেশে এই সংস্থার উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী হয়। ২০১৪-১৫ আর্থিক বর্ষে এই গ্রুপের মোট আয় ছিল ১০৮.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
২) ডাবর - ১৮৮৪
কলকাতার এক অখ্যাত গলিতে ছিল ডাক্তার এস কে বর্মনের চেম্বার। সেখানেই বহু দূরদূরান্তরের গ্রাম থেকে আসা মানুষের চিকিৎসা করতেন। চিকিৎসায় ব্যবহার করতেন নিজস্ব আয়ুর্বেদিক ঔষধির। একেবাররে সাক্ষাত ধন্বন্তরি। শ্রদ্ধাবশত মানুষ ওঁকে ‘ডাক্তার বর্মন’ বলে সম্বোধন করত। ওঁর ওষুধের বিস্ময়কর সাফল্যের কথা দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার বর্মন হয়ে ওঠেন এই অঞ্চলের একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক। তৈরি হয়ে যায় তাঁর ওষুধের ব্র্যান্ড। ‘ডাবর’। – সংস্থার এই নামটি এসেছে ওঁর নাম ‘ডাক্তার বর্মন’ থেকে।
পশ্চিমবঙ্গের একটা ছোটো ক্লিনিকে শুরু হওয়া এই আয়ুর্বেদিক উদ্যোগ বর্তমানে ভারতবর্ষের চতুর্থ বৃহত্তম FMCG সংস্থা। ২০১৩-১৪ আর্থিক বর্ষে এই সংস্থার মোট আয় ছিল ৭,৮০০ কোটি টাকা (ভারতীয় মুদ্রায়) এবং বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান আয়ুর্বেদিক ও ভেষজ ঔষধি প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসাবে পরিচিত। উৎপাদিত সামগ্রীর নিরীখে এই সংস্থার মোট ২১ টি বিভাগ রয়েছে এবং রয়েছে ৩৮১ টিরও বেশি বিশ্বস্ত প্রোডাক্ট।
৩) গোদরেজ - ১৮৯৭
ওকালতি ছেড়ে এক আইনজীবি যখন তালা বানানোর ব্যবসা শুরু করেন, তখন তিনি ভাবতেও পারেননি যে তাঁর এই উদ্যোগ একদিন একটি বিশ্বমানের সংস্থায় পরিণত হবে। উন্নততম কিছু ‘সেফ’ ও ‘সিকিউরিটি ইকুইপমেন্ট’ তৈরিতে সাফল্য লাভের পরে নিরলস এই উদ্যোগপতি সাবান থেকে শুরু করে সাদা তেল পর্যন্ত বিবিধ ধরনের পণ্য তৈরির উদ্যোগ নেন। আর্দেশির গোদরেজের স্বপ্ন ছিল একটা ‘গ্লোবাল ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ড’ তৈরি করা। এবং তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে আরো এগিয়েছে পিরোজশা গোদরেজের হাত ধরে।
বর্তমানে এই সংস্থা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্নিচার, সিকিউরিটি, এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্ট, রিয়েল এস্টেট, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সহ বিবিধ ভোগ্যপণ্য সামগ্রী উৎপাদন করে।
৪) নীলগিরিস - ১৯০৫
বেঙ্গালুরুর ব্রিগেড রোডের মুখে অবস্থিত ছিমছাম দোকানটিকে দেখে কে-ই বা ভাবতে পারে যে এটা দক্ষিণ ভারতের সবথেকে পুরানো সুপারমার্কেটগুলির মধ্যে একটি? এই সুপারমার্কেট নীলগিরি গড়ে উঠেছে এস আরুমুগা মুদালিয়ারের হাত ধরে। মুদালিয়ার আগে তামিলনাড়ুর ইরোড জেলায় ব্রিটিশদের পত্রবাহক হিসাবে কাজ করতেন। উনি ব্রিটিশদের চেক ও চিঠিপত্র কোয়েম্বাটুর থেকে কুনুর ও উটিতে পৌঁছে দিতেন। শোনা যায় যে চিঠি পৌঁছাবার সময় অনেকে ওনাকে কিছু দুগ্ধসামগ্রীও পৌঁছে দেবার জন্য অনুরোধ করত। এবং এখান থেকেই উনি মাখনের ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবেন এবং সেইমত বন্নারপেটে এক ইংরেজের থেকে মাখনের ফার্ম কিনে নেন। এভাবেই পথ চলা শুরু হয় নীলগিরি ডেয়ারি ফার্মের।
সংস্থার নাম থেকে এটা সহজেই অনুমেয় যে এই ফার্মে মূলত দুগ্ধজাত দ্রব্য ও অন্যান্য কনফেকশনারি উৎপাদন করা হয়। আরুমুগার ছেলে চেন্নিয়াপন ইউরোপ ও আমেরিকা সফর থেকে ফেরার পর সুপারমার্কেট তৈরির পরিকল্পনা করেন। ব্রিগেড রোডের এই দোকানটি তৈরি হয় সন ১৯৩৬ এ। দেশ স্বাধীন হবার পর মুদালিয়ার পরিবার ইরোডে একটি উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলেন। নীলগিরি দক্ষিণ ভারতের গৃহস্থালীর সামগ্রীতে খুব পরিচিত একটি নাম। ২০০৯ সালে অ্যাকটিস নামক ইংল্যান্ডের একটি অর্থলগ্নি সংস্থা নীলগিরিতে ৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করে এবং ২০১৪’র নভেম্বর মাসে ‘ফিউচার কনজিউমার এন্টারপ্রাইজ’ অ্যাক্টিস ও তার সহকারী সংস্থাগুলির ৯৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। তাই বর্তমানে নীলগিরি হল ফিউচার কনজিউমার এন্টারপ্রাইজের একটি শাখা সংস্থা।
৫) রুহ্ আফজা – ১৯০৭ (হামদর্দ)
হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদের তৈরি করা বিবিধ ভেষজ উপাদান, সব্জি ও ফলের নির্যাস দিয়ে তৈরি একটি রেসিপিই গৃহস্থের কাছে পরিচিত ‘রুহ্ আফজা’ নামে। এতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, সেগুলি প্রাকৃতিক উপায়ে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে। আর তাই উত্তর ভারতের রুক্ষ গরম ও কড়ালু-বাতাসের প্রকোপ থেকে শরীরকে আরাম দিতে এই রুহ্ আফজা অব্যর্থ। বর্তমানে রুহ্ আফজা ছাড়া কোনোরকম ফালুদা বানানোর কথা ভাবাই যায়না।
হাকিম মজিদ ছিলেন একজন নামকরা ইউন্যানি চিকিৎসক। শোনা যায়, যে, পুরানো দিল্লিতে অবস্থিত নিজের ক্লিনিক থেকেই উনি নাকি প্রথম রুহ আফজা বিক্রয় করা শুরু করেছিলেন। দেশভাগের পর হামদর্দের মোট দুটি পৃথক পৃথক শাখা সক্রিয় ছিল বলে জানা যায় – একটি করাচিতে এবং অপরটি দিল্লিতে।
তবে ‘রুহ্ আফজা’ নামকরণ কিভাবে হয়েছিল, সে অধ্যায় এখনো রহস্যাবৃত। এ বিষয়ে অনেকের অনেকরকম মতামত রয়েছে। কারুর কারুর বক্তব্য অনুসারে, হাকিম পুরাণ বা লোকগাথার প্রাচীন কোনো গ্রন্থ থেকে এই নামটি পেয়েছিলেন।
৬) ভদিলাল - ১৯০৭
১৯০৭ সালে ভদিলাল গান্ধীর হাত ধরে যার সূত্রপাত হয়েছিল একটি সোডা ফাউন্টেন হিসাবে, বর্তমানে তা ভারতবর্ষের দ্বিতীয় বৃহত্তম আইসক্রিম নির্মাতা সংস্থা হিসাবে পরিচিত। একদম গোড়ার দিকে ভদিলাল হস্তচালিত মেশিনের সাহায্যে আইসক্রিম বানাতেন। এই মেশিনের মধ্যে একসাথে দুধ, বরফ ও নুন মিশিয়ে আইসক্রিম প্রস্তুত করা হত এবং তারপর থার্মোস বক্সে করে সেটা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হত। পরব্ররতীকালে এই সোডা ফাউন্টেনের মালিকানা হস্তান্তরিত হয় ভদিলালের ছেলে রণছোড়লালের কাছে, যিনি ১৯২৬ সালে এখানে রিটেল অপারেশান এর ব্যবস্থা চালু করেন।
শীঘ্রই ‘ভদিলাল’ আসক্রিম প্রস্তুত করার যন্ত্র আমদানি করতে শুরু করে এবং দেশের বিভিন্ন অংশে নিজেদের বিপনণি গড়ে তোলে।
৭) এম টি আর -১৯২৪
যজ্ঞনারায়ন মাইয়া ও ওনার ভাইয়েদের উদ্যোগে বেঙ্গালুরুর জনবহুল জে সি রোডের উপর গড়ে ওঠা এম টি আর রেস্তোঁরা অতীতের মতই এখনও ভীষণভাবেই জনপ্রিয়। শোনা যায় যে, এখানকার বাটার দেওয়া সুস্বাদু ধোসা খাবার জন্য একদিন নাকি স্বয়ং কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীকেও লাইনে দাঁড়াতে হয়েছিল। অনেকের মতে, রাভা ইডলি নাকি প্রথম বানানো হয়েছিল এই রেস্তোঁরাতেই।
ইডলি বানানোর প্রধান উপরকণ যে চাল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই চালের যোগানে ঘাটতি দেখা দেয়। তখন এম টি আর রেস্তোঁরার শেফ্রা চালের বদলে সেমোলিনা দিয়ে ইডলি বানাবার সিদ্ধান্ত নেন, এবং এইভাবেই প্রথম রাভা ইডলি তৈরি হয়। একদিকে রেস্তোঁরা ও অন্যদিকে ‘প্রি প্যাকেজ্ড ফুড’ – এম টি আর বর্তমানে এই দুইভাবে ব্যবসা চালায়।
৮) পার্লে-জি - ১৯২৯
পার্লে-জি বিস্কুট না থাকলে এদেশে চায়ের আয়োজন অসম্পূর্ন থেকে যায়। বিশ্বের বৃহত্তম বিস্কুট বিক্রেতা সংস্থা হিসাবে পরিচিতিই পার্লে জি কোম্পানি গড়ে ওঠে ১৯২৯ এ, মুম্বাইয়ের ভিলে পার্লেতে। ১৯৩৯ সাল থেকে বিস্কুট তৈরি করা শুরু হয় এবং স্বাধীনতার পর প্রথম প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনে এই ‘পার্লে-জি’কে হাজির করা হয় ব্রিটিশ বিস্কুটের বিপরীতে ভারতের নিজস্ব গ্লুকো ব্র্যান্ড হিসাবে। ২০১৩ সালে এটাই ছিল লভ্যাঙ্ক ৫০০০ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়া প্রথম FMCG ব্র্যান্ড।