রাইট ব্রাদার্সের উত্তরসূরি কালনার শুভঞ্জন
পৃথিবীর ইতিহাসে যে সব আবিষ্কার মানুষকে মানুষ করেছে তার মধ্যে রাইট ব্রাদার্সের বিমান বোধহয় একের দাগে থাকে। কলোম্বাসের যে কাজ করতে মাসের পর মাস লাগত সেটা কয়েক ঘন্টায় করে ফেলতে শিখিয়েছেন রাইট ব্রাদার্স। বিমান বিনা গতি নাই। মানুষ দুটি ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে, পক্ষীরাজে পাড়ি দিচ্ছে রাজপুত্তুর। এসব রূপকথার গল্প শোনা গ্রাম বাংলার এমন শিশু নেই যে আকাশে প্লেন দেখে মাঠে ছুটে যায় না, ঘুমিয়ে, জেগে, হাত দিয়ে, কাগজ দিয়ে প্লেন বানিয়ে নানান কল্পনায় ডুব দেয় না। আজ আপনাদের এমনই একজনের সঙ্গে আলাপ করাবো যে আর পাঁচটা শিশুর থেকে একটু এগিয়ে ছিল। আজ তাই দৌড়ে অনেককেই পিছনে ফেলে দিয়েছে। ছেলেটির নাম শুভঞ্জন সাহা। বাড়ি বর্ধমানের কালনায়। এম সি এ র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
লড়াই কাকে বলে তা রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছেন শুভঞ্জন। বাবা অজয় কুমার তাঁত বুনে সংসার চালান। কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছোটোবেলা থেকেই নীল আকাশে পাল তোলা এরোপ্লেন দেখলেই মনে মনে ভাবতো শুভঞ্জন কি করে এটা বানানো যায়। টিফিনের পয়সা জমিয়ে পাড়ার টি ভি সারানোর দোকান থেকে পুরনো মোটোর কিনে পিচবোর্ড দিয়ে হেলিকপ্টার বানিয়ে ফেলেছিল। সকলে অবাক হয়ে দেখেছিল ছোট্ট ছেলেটার খেলনা চপার তরতর করে দৌড়য়। কিন্তু ক্লাস এইটের বাচ্চাটা জানতো না কিভাবে সেটা আকাশে ওড়ানো যেতে পারে। রাতদিন ভাবত সেই ভাবনা। এই সময়ে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ার মত তার জীবনে এলো অন্ধকার। মা মারা গেল। সবাই বলত আকাশে গেছেন। তারা হয়ে। রোজ সকালে ঝরে পড়েন বিন্দু বিন্দু শিশির হয়ে। সেই থেকে আকাশ আরও রহস্যময় বালক শুভঞ্জনের কাছে। বুক দিয়ে আগলালেন বাবা। গরিব বাবার বুকের চরে বসে নীল আকাশে পাল তোলার স্বপ্ন দেখতেন শুভঞ্জন। মা নেই। কিন্তু আকাশ তো আছে।
ছোটোবেলায় কার্গিল যুদ্ধের খবর পড়েছেন কাগজে। টিভি তে দেখেছেন আকাশের একপ্রান্ত চিরে অন্যপ্রান্ত ছুঁয়ে যাচ্ছে মিসাইলের সাদা রেখা। সারা রাত জিঘাংসার তারা খসা দেখে দেখে দুচোখ ভাসিয়েছে ছেলেটা। কাকা ছিলেন সীমান্তরক্ষী। কার্গিলে পোস্টিং। যুদ্ধে মারা যান কাকা। শহিদ। ইতিহাস, ভুগোল, রূপকথা, বিজ্ঞান, দেশপ্রেম, রাজনীতি, সাজানো যুদ্ধ, আরোপিত শান্তি সব গুলিয়ে যায় শুভঞ্জনের। কাকার মৃত্যুতে শপথ নেন এমন কিছু করবেন যা ভারতীয় সেনার কাজে লাগে। আবিষ্কারের বাইরে কিছুই আর ভাবতে পারত না ছেলেটা। মনস্থির করে আকাশ পথে নজরদারি চালানোর জন্য অত্যাধুনিক ড্রোন তৈরি করবেন। তবে খরচ কোথা থেকে আসবে তা ভেবে কূল পাচ্ছিল না সে। মাঝে কেটে যায় কয়েকটা বছর। ইতিমধ্যেই স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে শ্যামবাজার মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হন।
নিজে টিউশন পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ চালিয়ে শপথের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা ভোলেনি। মাথা থেকে আকাশ, তারা খসা, বিমান ওড়ানোর ভাবনা দূর হয়নি। কিন্তু কোনও টেকনিক্যাল সাপোর্ট নেই, টাকার যোগান নেই, গবেষণা করার সামান্য পরিকাঠামো নেই। এরকম প্রতিবন্ধকতাতেও হাল ছাড়েননি। এরই মধ্যে দেশের মানুষকে নিরাপত্তা দিতে বানিয়ে ফেলেছেন অত্যাধুনিক ড্রোন। যা ভারতের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরী হবে বলে দাবি এই লড়াকু যুবকের। এই ড্রোন তৈরি করে ইতিমধ্যে একাধিক পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।
অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে ২০১২ সাল নাগাদ বানিয়ে ফেলেন তাঁর স্বপ্নের আকাশচারী বিমান। ২৮ইঞ্চি লম্বা এই বিমান রিমোর্ট কন্ট্রোল বা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এর মাধ্যমে চালনা করা যায়। ঘণ্টায় গতিবেগ ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার। এতে লাগানো যায় ক্যামেরা। যার সাহায্যে শত্রুপক্ষের গতিবিধির ওপর নজরদারি চালানো অনেক সহজ, বলে দাবি শুভঞ্জনের। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত এলাকা থেকে মানুষকে উদ্ধার করা বা ত্রাণ ও মেডিসিন পৌঁছে দেওয়াও সহজ হবে। ২০১৩ সালে খড়গপুর আই আইটি থেকে জাতীয় স্তরে দ্বিতীয় পুরস্কার পায় শুভঞ্জনের ড্রোন বিমান। এরপর ২০১৪ সালে কানপুর আই আইটিতে প্রথম পুরস্কার পায়। এই দুটি পুরস্কারের অর্থমূল্য তার গবেষণাকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ড্রোন কোনও নতুন জিনিস নয়। কিন্তু এই শুভঞ্জনের হাতে গড়া ড্রোনে রয়েছে আবেগের ইঞ্জিন। কল্যাণী গভঃ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এই ছাত্র। স্বপ্ন দেখে নতুন ধরনের সামরিক বিমান তৈরি করার।
জন্মগবেষক ছেলেটা পুরোদস্তুর গবেষণার কাজেই নিজেকে নিযুক্ত রাখতে চায়। আর্থিক বাধা টপকে কীভাবে উড়বে? শুভঞ্জনের এখন সেই ভাবনা।