ঘুরে দাঁড়ানোয় অপরাজিতা বাংলার পৌলমী
এপ্রজন্মের নারী বিশ্বাস করে, মেয়েরা সব পারে। ওঁরা দশভূজা। শুধু ঘর বা শুধু কেরিয়ার নয়। একইসঙ্গে দুটোই সমান তালে হ্যান্ডেল করা রীতিমতো রপ্ত করে নিয়েছেন তাঁরা। যেমন পৌলমী ঘটক। এই মুহূর্তে মাতৃত্বের স্বাদ চেটেপুটে উপভোগ করছেন টেবলটেনিসে সাতবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন এই বাঙালি অ্যাথলিট। ২০১১ টেবলটেনিসেরই সৌম্যদীপ রায়ের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন। ২০১৫-য় কিয়ানের জন্ম।
কিন্তু এটা তো পৌলমীকে বর্ণনা করার জন্য যথেষ্ট নয়। এ মেয়ে তো বাংলার টেবলটেনিসের গ্ল্যামারগার্ল। দক্ষিণ কলকাতার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা দুনিয়া। বাড়িতে খেলাধুলোর প্রতি ভালবাসা ছিলই। দাদু লুকিয়ে ফুটবল খেলা দেখতে মাঠে নিয়ে যেতেন। বাবা ব্যাডমিনন্টন খেলেছিলেন রাজ্যস্তরে। বাড়ির দুরন্ত মেয়েটা সারাক্ষণ ফুটছে। খেলার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক। বাড়ির উল্টোদিকে বৈশাখী সঙ্ঘের কোচিং ক্যাম্পে ভর্তি করে দিয়ে আসা হল বছর আটেকের পৌলমীকে। নবনালন্দায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকল টিটি শেখার পালা। ১৯৯৩ সালে দশ বছর বয়সে ন্যাশনালে খেলার সুযোগ পান। তারপর থেকে শুধুই এগিয়ে যাওয়া। ক্লাস সেভেনে গ্লাসগোয় সিনিয়র ইন্ডিয়ার হয়ে খেলার সুযোগ। তবে স্কুলের তরফ থেকে সবসময়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। টুর্ণামেন্টে খেলতে যাওয়ার জন্য আলাদা করে বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৮ সালে জীবনের সেরা সম্মানটা এখনও পৌলমীর মনে উজ্জ্বল। জীবনে অনেক সম্মান, অনেক উপহার পেয়েছেন। কিন্ত প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য স্কুলে হাফ ডে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেছিল একেবারে অন্য অনুভূতি। ১৫ বছরের মেয়েকে এই ঘটনা দারুণ মোটিভেট করেছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিল টিটি-র হাত ধরে আকাশ ছোঁওয়া যাবে। ছুঁলেনও তাই।
রেলের দুটো লাইন যেরকম পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটে, ঠিক সেভাবেই এগোচ্ছিল টিটি ও পড়াশুনো। আসলে টেবল টেনিস খেলার পাশাপাশি পড়াশুনো করাটাও যে জরুরি। ভারতীয় পঠন-পাঠন ব্যবস্থায় খেলার গুরুত্ব দিয়ে কারিকুলামের ব্যবস্থা তো নেই। এটাই সবচয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠিছল পৌলমীর। এমনকি মাধ্যমিকের বছর পরীক্ষাই দেওয়া হল না। সে বছর অলিম্পিক্সে ভারতীয় টিটি দলের সদস্য ছিলেন পৌলমী। ১৬ বছর বয়সে খেলার স্বীকৃতি হিসেবে ভারত পেট্রোলিয়ামে ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি হিসেবে প্রথম চাকরি। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা। বাড়ির ইচ্ছায় এমবিএতে ভর্তি হলেও তা কন্টিনিউ করা হয়নি। আসলে এটা ভালই লাগত না পৌলমীর।
পড়াশুনো সামলে স্বপ্নের উড়ানে ডানা মেলে ওড়া চলছিলই। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ৩ বারের জুনিয়র ও ৭ বারের ন্যাশানাল চ্যাম্পিয়ন। ২০০৯ সালে পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ। ২০১০ দিল্লিতে আয়োজিত কমনওয়েলথ গেমসে দলগত রূপো জয়ের আনন্দ আজও দারুণ মনে পড়ে।
তবে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পথে কাঁটার খোঁচাও তো ছিল! ছোটবেলায় রীতিমেতা হোমসিক ছিলেন। পাশাপাশি যে সমস্যাটা ভোগাত সেটা হল বিভিন্ন কোচদের ভিন্ন ভিন্ন কোচিং প্যাটার্ন। তবে অ্যাডজাস্ট করে নিতে বেশি সময় নেননি এই বঙ্গতনয়া। সিনিয়রদের সঙ্গে তাল মিলয়ে চলা থেকে বিভিন্ন টুর্ণামেন্টের দলে পারফরমেন্স দিয়ে জায়গা করে নেওয়া সবই সামলেছেন। কখনও ফ্লিক করে কখনও আবার স্ম্যাশ করে। আসলে টিটি বোর্ডের ওপর দখল রাখতে যেমন দক্ষতা প্রয়োজন তেমনি এগিয়ে যাওয়ার রাস্তায় বাধাগুলো টপকানোও ভীষণ জরুরি।
এখন পৌলমী মা। ভালো গৃহিনী। তাতে কী। জেগে ওঠার আনন্দে সারাক্ষণ ফুটছেন। স্বপ্ন দেখছেন ফের জাতীয় চ্যাম্পিয়েনশিপের খেতাব জয়ের। নিজেকে ফের তৈরি করতে মরিয়া পৌলমী ঘটক। তিনি বলেন, মাতৃত্বই কেরিয়ারের ফুলস্টপ নয়। বরং ওটা একটা কমা, যেখানে দাঁড়িয়ে নিজের কেরিয়ারটা আরও একটু প্ল্যান করে নেওয়া যায়। মাতৃত্ব ওঁকে বাড়তি শক্তি দিচ্ছে। কিয়ানোর মুখের দিকে চেয়ে পৌলমী ঘুড়ে দাঁড়ানোর জন্যে তৈরি। আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করার জন্য ওঁর শুধু প্রয়োজন একটা ট্রাই। বাকি হিট-ফ্লিক-স্ম্যাশ কী দারুণ করা যায় সেটা ওঁর থেকে ভালো আর কে জানে?