চায়ের ঠেকের ভোল বদল সুকৃতদের চায়েওয়ালা
বন্ধুবান্ধবরা যখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হওয়ার প্রস্তুতি নিতেন, তখন নিজের কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন সুকৃত। সুকৃত পোদ্দার। শান্তিনেকতনে হিস্ট্রি অফ আর্টস নিয়ে পড়ার সময় একবছরের সিনিয়র অভিষেক রায়ের সঙ্গে আলাপ। অভিষেক তখন টেক্সটাইল ডিজাইনিং-এ মজে। দুজনেরই লক্ষ্য ছিল, খুব সিরিয়াস কিছু হবে না, অথচ সিগনেচার স্টাইল থাকবে।
শান্তিনিকেতনের আলসা ক্যাফে দেখে মনে হয়েছিল ক্যাফেটেরিয়া করবেন।“কিন্তু কলকাতায় তো ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ক্যাফেটেরিয়া। ব্যবসায় নামার আগেই প্রতিযোগিতার বিশাল পুল অপেক্ষা করে থাকবে আমাদের জন্য। তখনই মাথায় ভাবনা এল কফি নয়, চা-হবে আমাদের ফোকাস। কারণ বাঙালি অতিথি আপ্যায়ন করে চা পরিবেশন করে। তাই চা-টেরিয়া হলে মন্দ হয় না।” বলছিলেন সুকৃত।
সুকৃতের বাবা ফ্রিলান্স ফোটোগ্রাফার। হয়তো তিনিই পরোক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন সুকৃতের ভাবনায়। তাই কখনও চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার প্রস্তুতি নেননি তিনি। অন্যদিকে, অভিষেকের পরিবারে সকলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হলেও চিন্তাভাবনার দিক থেকে কেউ সেঁকেলে বা পশ্চাদপসারী নন। ফলে সৃজনশীল ভাবনাকে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি তাঁরাও।
এই নামকরণের পিছনেও রয়েছে আরেক গল্প। একবার স্কুলের এক শিক্ষিকার সঙ্গে নিজের ভাবনা নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আলোচনা করছিলেন সুকৃত। ওই মহিলা শুনেই সুকৃতকে বলেছিলেন, “এত ভাবনা এত পরিশ্রম চা-ওলা হওয়ার জন্য?” ‘সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলাম নাম দেব চায়ওয়ালা’, বলছিলেন সুকৃত।
সেইসময় কলকাতায় দু-একটি ছাড়া ক্যাফের পাশে লাইফস্টাইল স্টোর বড় একটা ছিল না। তখন অভিষেকও টলিউডে কাজ শুরু করেছেন। নিজের ব্র্যান্ড করার ভাবনা ছিল অভিষেকেরও। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে পথ চলা শুরু সুকৃতের চায়ওয়ালা আর অভিষেকের বহুরূপীর। ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে অবশ্য একটু বেশি সময় লেগে গিয়েছিল তাঁদের। কারণ দেওয়ালের ছবি, পলিশিং, কাঠের কাজ, আসবাব এককথায় চায়ওয়ালার ইন্টিরিয়রের কৃতীত্বও সুকৃত-অভিষেকেরই প্রাপ্য।
অল্পদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠল চা-টেরিয়া। লাগোয়া বহুরূপীও গ্রাহকদের মনে জায়গা করে নিল। অভিষেকের কথায়, সিরিয়াস ফ্যাশনে নয়, তাঁর ব্র্যান্ডের উদ্দেশ্যই ছিল ক্যাসুয়াল ক্লোদিং সেক্টর ফ্লন্ট করা। প্রথমদিকে, আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বহরূপী। ধীরে ধীরে গ্রাহাম’স ল্যান্ড আর টলিউডের গণ্ডী পেরিয়ে বহুরূপী পৌঁছেছে অন্য শহরে। ফ্যাশন উইকে অংশগ্রহণ করে নিজের অর্গ্যানিক ফ্যাব্রিকের কাজকে ভিন রাজ্যেও জনপ্রিয় করে ফেলেছেন অভিষেক। জুন-জুলাই থেকে দিল্লি, মুম্বইয়ের স্টোরেও মিলবে অভিষেকের এই ব্র্যান্ড। বহুরূপীর পাশাপাশি চায়ওয়ালার পিআর দেখেন তিনি। পলিসি মেকিংয়েরও দায়িত্ব সামলান। বাকি সবটাই সুপারভাইজ করেন সুকৃত।
ব্যবসায় নামার আগে কিছুটা হলেও সুকৃতের থেকে অ্যাডভান্টেজ-এ ছিলেন অভিষেক। কারণ টেক্সটাইল ডিজাইনিং নিয়ে পড়াশোনা করায় এই ফিল্ডটা তাঁর দখলে ছিল। কিন্তু সুকৃতের জন্য লড়াইটা আরও একটু বেশি কঠিন ছিল। কারণ, আর পাঁচজন ভোজনরসিক বাঙালির যেমন থাকে সুকৃতেরও সেটুকুই ছিল। কিন্তু ফুড বা কুকিং সম্পর্কে তাঁর কোনও সম্যক ধারণা ছিল না, ছিল না কোনও প্রশিক্ষণও। তাই মেনু ঠিক করতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। তবে কাজটা যে তিনি ভালই করেছিলেন, চায়ওয়ালার লোভনীয় মেনু কার্ডই তার প্রমাণ। এখানকার গ্রিলড চিকেন বার্গার, সয়ে হানি চিকেন উইংস, চিজ সস পাস্তা এককথায় জিভে জল এনে দেয়। এছাড়া চা-এর রকমারি তো আপনাকে চেখে দেখতেই হবে। বিশেষ করে, কাশ্মীরি কাওয়া গ্রিন টি, জ্যাসমিন টি। আর যাঁরা বরফ চা বা আইসড টি পছন্দ করেন তাঁদের জন্য রয়েছে, প্যাশন ফ্রুট আইসড টি, ভ্যানিলা আইসড টির মতো পানীয়ও।
ফুডজয়েন্ট লাগোয়া লাইফস্টাইল স্টোর এই কনসেপ্ট কী কলকাতায় নতুন? অভিষেক আর সুকৃত দুজনেরই মতে, এমন ধারণা প্রথম না হলেও বেশ নতুন কলকাতায়। আপাতত মাস কয়েকের অভিজ্ঞতা বলছে, আইডিয়া ক্লিক করেছে। যদিও দুজনেই মনে করেন, ক্রমাগত এক্সপ্লোর করে যেতে না পারলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে। তাই লাগাতার পরীক্ষা নিরিক্ষার কোনও বিকল্প নেই।
লাইফস্টাইল স্টোরে শুধু পোশাক আশাকের সম্ভার নয়। রয়েছে, কফি মাগ, হ্যান্ডমেড কার্ড, অ্যাক্সেসরিজ। সুকৃত জানালেন, কফি মাগ আর নোটবুক পেপার কাপ বলে একটি স্টার্টআপের। আর কার্ডগুলি রেড ক্রাফটের সৌজন্যে যার অন্যতম উদ্যোক্তা সুকৃত নিজেই। সেরামিক-এর শো পিস আউটসোর্স করা হয়েছে সুকৃতদেরই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনীদের থেকে। এককথায় টুকরো টুকরো স্টার্টআপের কোলাজে পূর্ণতা পেয়েছে এই চায়ওয়ালা যা নয়া প্রজন্মের কাছে তো বটেই, সব বয়সের গ্রাহকদেরই সৃজনশীলতার গুণে টেনে টানছে গ্রাহাম’স ল্যান্ডে।
স্টার্টআপ-দের কি টিপস দেবেন?
সুকৃত বললেন অধ্যবসয়ের কোনও বিকল্প নেই। আর অভিষেকের কথায়, Whatever you feel good, just do that.