গঙ্গার পবিত্রতা ফেরাতে উদ্যোগী ‘অগস্ত্য’
সালটা ১৯৮৬। গঙ্গা দূষণমুক্ত করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধি গঙ্গা অ্যাকশন প্লান চালু করেন। বরাদ্দ ছিল ৪৬২ কোটি টাকা। এরপর বিগত ৩ দশকে গঙ্গাকে সাফ সুতরো করার পিছনে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। তবুও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নদীগুলোর মধ্যে গঙ্গার নাম ৫ নম্বরে – দূষণের পরিমাণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’-র নির্ধারিত মাত্রার থেকে ৩০০০ গুণ বেশি।
আবহমানকাল ধরে বয়ে চলা গঙ্গাকে পরিষ্কার করতে অবশ্য পৌরাণিক তত্ত্বেই ভরসা রাখছেন IIEST শিবপুরের দুই তরুণ প্রযুক্তিবিদ। প্রান্তিক সিনহা এবং সন্দীপ নায়ার। অগস্ত্যসংহিতায় দেখানো পথেই তাঁরা গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করায় ব্রতী হয়েছেন। তাঁদের সংস্থা অগস্ত্য বাওয়েন্ট ইনফ্লেটেবল প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেই গঙ্গা সাফাইয়ের অসম লড়াইয়ে নাম লিখিয়েছে।
লতা-পাতা, প্লাস্টিক, জলের বোতল আরও কত কীই না গঙ্গার জলের সঙ্গে বয়ে চলে। এইসব ভাসমান বর্জ্য সরাতে ‘অগস্ত্য’র ট্র্যাশ বুম-এর জুড়ি মেলা ভার।
ট্র্যাশ বুম কী?
ট্র্যাশ বুম আদপে পলিমার কোটিং করা ফ্যাবরিক দিয়ে তৈরি ১৫ ফিট লম্বা বেলুন। আকারে চ্যাপটা। নিচের অংশে চেন বাঁধা। একটা বেলুনের শেষ প্রান্তের সঙ্গে অন্য বেলুন জোড়া লাগানো যায়। সেই চ্যাপটা বেলুন ফুলিয়ে জলে ফেলে দিলেই হল। জলের যতটা জায়গা ট্র্যাশ বুম ঘিরে রাখবে, ততটা জায়গার যাবতীয় ভাসমান বর্জ্য এসে আটকে যাবে চ্যাপটা বেলুনের ফাঁদে। ১৫ ফিটের একটা বেলুন ২৮০ কেজি ওজন বহনে সক্ষম। ৬জন মিলে যে জলাশয় পরিষ্কার করতে একটা গোটা দিন লেগে যায়, মাত্র ৪ জনেই কয়েক ঘণ্টায় সেই কাজ করে ফেলতে পারবে ট্র্যাশ বুমের সাহায্যে। শুধু ভাসমান বর্জ্য সাফ করাই নয় অগস্ত্য বাওয়েন্টের সিটিও প্রান্তিকের দাবি জলযান থেকে নদীতে ছড়িয়ে পড়া তেল সহজেই পরিষ্কার করতে পারে ট্র্যাশ বুম।
ট্র্যাশ বুমের আরও ব্যবহার আছে। যেমন বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠা নদীর গতি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে এনে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা। আবার কখনও চারদিক ঘিরে দিয়ে স্নানঘাটের নিরাপত্তা বাড়ানো।
নাব্যতা কমে যাওয়া গঙ্গার আরও একটা সমস্যা। নদীতে ডুবে থাকা ট্রলার, জাহাজ সেই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ডুবে যাওয়া জলযান উদ্ধারের খরচা অনেক, সময় সাপেক্ষও বটে। তাই খুব একটা প্রয়োজন না পড়লে সেই পথে কেউ হাঁটে না। এতে লোকসান তো হয়ই, অন্যান্য জলযানের জন্য নদী বিপজ্জনকও হয়ে ওঠে। এই সমস্যা সমাধানের পথ দেখাচ্ছে আন্ডার ওয়াটার লিফট ব্যাগ। প্রাথমিকভাবে সেনাবাহিনীর জন্যই এই যন্ত্র তৈরি করেছিলেন প্রান্তিক-সন্দীপরা। পরে তার বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়। এই যন্ত্রের পিছনেও রয়েছে অগস্ত্যর ইনফ্লেটেবল প্রযুক্তি। জলের নিচে পড়ে থাকা বস্তুর সঙ্গে আটকে দিতে হবে বেলুন। এরপর বেলুনে হাওয়া ভরতেই ম্যাজিকের মতো তা জলের তলা থেকে ভেসে উঠবে। প্রান্তিক জানিয়েছেন, “প্রচলিত পদ্ধতিতে ডুবে যাওয়া ট্রলার টেনে তুলতে কমপক্ষে ২টো ক্রেন ও জনা পঞ্চাশেক লোকবল লাগে। আন্ডার ওয়াটার লিফট ব্যাগ দিয়ে মাত্র ১০ জন মিলেই একটা ট্রলার টেনে তোলা সম্ভব”, দাবি অগস্ত্য কর্ণধারের।
ট্র্যাশ বুমের মতো আন্ডার ওয়াটার লিফট ব্যাগেরও অন্য ব্যবহার আছে। যেমন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা কিংবা ফিস অ্যাকোয়া কালচারে এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো যায়।
ভারতে কি এই প্রযুক্তি নতুন?
বিদেশে ট্র্যাশ বুম কিংবা আন্ডার ওয়াটার লিফ্ট ব্যাগ ব্যবহারের প্রচলন থাকেলও ভারতে এই প্রযুক্তি একেবারে নতুন বলেই দাবি অগস্ত্য বাওয়েন্টের। বিদেশি প্রযুক্তিতে অদল-বদল ঘটিয়ে এদেশে ব্যবহারযোগ্য করে তুলেছে সংস্থাটি।
এই প্রযুক্তিকেই কেন বাছল অগস্ত্য?
সংস্থার চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার সন্দীপ জানিয়েছেন, “বেলুন জিনিসটাকে লোকে হাল্কাভাবে নেয়, কিন্তু বেলুনের যে কত রকম ব্যবহার তা অধিকাংশ মানুষেরই ধারণার বাইরে। এদেশে সামাজিক ক্ষেত্রে বা বাণিজ্যিকভাবে ইনফ্লেটেবল প্রযুক্তির ব্যবহার হয় না বললেই চলে। আমরা ইনফ্লেটেবল প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে চেয়েছি।”
রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পর্যায়ে থাকার সময়েই ভারতীয় সেনাবাহিনী অগস্ত্য বাওয়েন্টের তৈরি আন্ডার ওয়াটার লিফ্ট ব্যাগের ব্যবহার শুরু করে। শিবপুর ও সংলগ্ন গঙ্গার ঘাটে ডেমনস্ট্রেশনের পর ট্র্যাশ বুম নিয়েও জনমানসে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। এতদিন চিরাচিত পদ্ধতিতে ভরসা রাখলেও দিন কয়েক কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট রবীন্দ্র সরোবর সাফাই অভিযানে ট্র্যাশ বুমকেই বেছে নিয়েছিল। সম্প্রতি একটি বিজনেস রিয়েলিটি শো-তে ফাইনালিস্ট
হয়েছে অগস্ত্য বাওয়েন্ট। ‘ব্লিম্প’ নামে পেল্লাই সাইজের বেলুন নিয়েও কাজ করছেন সংস্থার প্রযুক্তবিদরা। তবে এটির ব্যবহার জলে নয়, আকাশে। এয়ারশিপের আকারের বেলুনটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, আকাশপথে নজরদারি ও বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
গত জুলাইয়ে পথ চলা শুরু করেছে এই সংস্থা। গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার যে উদ্দেশে সংস্থার যাত্রা শুরু, সেই কাজে জনসচেতনতার অভাব একটা হার্ডেল বলে মনে করেন সংস্থার দুই প্রতিষ্ঠাতা। এপ্রসঙ্গে সন্দীপ জানান, “গবেষণার অঙ্গ হিসেবে আমরা অনেকটা সময় হাওড়া ব্রিজে কাটিয়েছি। দেখেছি কীভাবে প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট নিঃসঙ্কোচে গঙ্গায় ফেলে দেয়। তাই দূষণ আটকাতে প্রযুক্তি যথেষ্ট নয়, নিজেদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।”
টিম অগস্ত্যর সদস্য সংখ্যা আপাতত ৮। ব্রেক-ইভেনের গণ্ডি ছুঁতে তাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩ বছর। পরিকাঠামো বৃদ্ধির জন্য এই সংস্থা এখন বিনিয়োগকারীর খোঁজে। ভারতীয় বাজারে এই ধরণের ইফ্লেটেবল দ্ৰব্যে নিজেদের পথিকৃৎ দাবি করলেও প্রান্তিকরা প্রতিযোগিতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার লড়াই তো আর একা জেতা যায় না। হোক না প্রতিযোগিতা, অন্তত দিনের শেষে গঙ্গার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঠেকানো যাবে।