মাতৃত্বে অনন্য তৃপ্তি, কুকুর বেড়াল হনুমানকেই দিলেন সম্পত্তি
মা সন্তানকে ভালবাসবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই মায়ের কাহিনি খানিকটা আলাদা। বর্ধমানের বোরহাটের তৃপ্তি চক্রবর্তী। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। তবু বৃদ্ধা নন। মনে অনেকের থেকে অনেক তরুণ। মায়া মমতায় মোড়া এই নারী মা হননি। কিন্তু তাঁর সন্ততির সংখ্যা শতাধিক। মাতৃত্বে রীতিমত ডগমগ। সযত্নে লালন পালন করছেন প্রায় ৫০ টি সারমেয় আর প্রচুর বিড়াল। বআজ্ঞে হ্যাঁ। সারমেয় বিড়ালরাই তাঁর সন্তান সন্ততি। এখানেই শেষ নয় কয়েকটি হনুমানও রয়েছে তাঁর পরিবারে। সফেদ, পুলি, পার্ক, ভিম, নকুল এক এক জনের এক এক রকম নাম। পেশায় অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা তৃপ্তি দেবীর এদের নিয়েই ভরভরন্ত সুখি সংসার। সন্তান স্নেহে যেমন পশুদের দেখেন পশুরাও ওঁকে মায়ের মত ভালোবাসে। ওই সব অজ্ঞাত কূলশীল কুকুর বেড়ালদের থাকার জন্য নিজের আস্ত বাড়িটাই দান করেছেন।
ছোট বয়সে বাবা মার আস্কারাতেই পশু প্রেমের প্রেরণা পান। রাস্তাঘাটে আহত পশু দেখলে সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিতেন। কেউ পশুদের আঘাত করলে তার প্রতিবাদও করতেন। তখন থেকেই অবহেলিত পশুদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। ১৯৫৬ সালে বর্ধমানের একটি স্কুলে শিক্ষিকা হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। সেই সময় থেকেই রাস্তায় আহত পশুদের দেখলেই তাদের চিকিৎসা থেকে পরিচর্চা সবই নিজের হাতে নিজের খরচে করতে শুরু করেন। তবে পশুদের জন্য কিছু করার নেশাটা দিনের পর দিন আরও বাড়তে থাকে। ১৯৯৫ সালে চাকরি জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর তার ধ্যান জ্ঞান হয়ে ওঠে পশুরাই।
রাস্তায় আহত পশু দেখলেই নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে তাদের চিকিৎসা করান। তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে সেবা শুশ্রূষা সমস্ত তিনি নিজেই হাতেই করেন। আহত পশুদের সুস্থ করে কখনও তার জায়গায় ফিরিয়ে দেন, আবার কেউ যেতে না চাইলে নিজের বাড়িতেই রেখে দেন। এই ভাবেই একটা দুটো করে বাড়তে বাড়তে আজ তার সংখ্যা ৫০। এখনও তৃপ্তি দেবী তাদের সযত্নে লালন পালন করে চলেছেন। তবে এখন তার শারীরিক ক্ষমতা অনেকটাই কমেছে। নিজের পরিচর্চার জন্য কোনও পরিচারিকা না রাখলেও তার পোষ্য সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিজের পেনশেনের টাকা খরচ করে ২ জন কর্মী রেখেছেন।
১৯৯৮ সালে তৃপ্তি দেবী একটি সংস্থা তৈরি করেন। এই সংস্থার নামে নিজের বাড়িতেই তৈরি করছেন পশুসেবা কেন্দ্র। পশু চিকিৎসার জন্যে আধুনিক সরঞ্জাম আছে। রীতিমত হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছেন তৃপ্তি দি। তাঁর অবর্তমানেও যাতে এই কাজ চলতে থাকে তাই নিজের বসত ভিটেটাও এই সংস্থাকে দান করে দিয়েছেন তিনি। পোষ্য সন্তানদের কেউ যাতে উৎখাত না করতে পারে তাই আইনি ব্যবস্থাও পাকাপোক্তই করেছেন এই শিক্ষিকা। দান করেছেন সঞ্চিত অর্থও। তার অবর্তমানে এদের দেখাশোনার জন্য একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে পশু সেবার নজির হিসাবে পেয়েছেন বেশ কিছু স্বীকৃতি। এখনও তিনি কাজ করে চলেছেন। নিজের উদ্যোগেই বিভিন্ন এলাকায় পশুদের ভ্যাক্সিন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন, ও বিভিন্ন সেমিনার আয়োজন করেন। বিভিন্ন এলাকায় এই কর্মীরা ঘুরে আহত ও অসুস্থ সারমেয়, বিড়াল, হনুমানদের সংগ্রহ করে এবং এই হাসপাতাল বাড়িতে নিয়ে আসে।
রয়েছে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা। চাকরি জীবনে সঞ্চিত অর্থ আর পেনশেনের টাকা আর কিছু মানুষের সাহায্য সহযোগিতায় তৃপ্তি দেবী আজও এই কাজ করে চলেছেন।বয়সকে হার মানিয়ে মাতৃস্নেহে লালন পালন করছেন তার সন্তানকুলকে। এ এক অন্য মা এর বিরল দৃষ্টান্ত। তৃপ্তি দেবীর জন্য আজ একটাই বাক্য ‘মা তুঝে সেলাম’।