জীবনে সব থেকে বেশি কী চান, যার জন্যে আপনি দীর্ঘদিন হা পিত্যেস করে বসে আছেন? ধরুন যেমন অনেকে আছেন, দুর্দান্ত জায়গায় বেড়াতে যেতে চান। কেউ কেউ ফিগারটাকে ঠিক ঠাক করতে চান। কেউ আবার বিনিয়োগ চান। নিজের স্টার্টআপে ভিসি ফান্ডিং কেউ। কিন্তু আমি কী চাই জানেন, দীর্ঘদিন ধরেই আমি আশায় আশায় আছি আমার চামড়াটা একটু মোটা হোক।
দীর্ঘদিন ধরে। বছরের পর বছর বলতে পারেন। আমি চেষ্টা করেছি চামড়াটা মোটা করার। কী হয়! যদি আপনার জিনে না থাকে তাহলে অনেক কসরত করতে হয়। ঠিক ভুঁড়ি কমানোর মতোই। আপনি পেটের চর্বি ঝরিয়ে ছ প্যাক অ্যাব বানাতে চাইলে অনেক কালোয়াতি করতে হবে। কসরত করতে হবে। জানি চামড়াটা মোটা করতেও অনেক পরিশ্রম করতে হবে।
আর পাঁচটা জিনিসের মতোই আমার চামড়াটা মোটা না হওয়ার জন্যে আমি আমার বড় হয়ে ওঠাটাকে খুব দোষ দিই। সবাই দোষি। আমার মা, বাব, মাস্টার মশাই দিদিমণি। সবাই! সব্বার দোষ। ওরা আমাকে এভাবে মানুষ করেছে বলেই চামড়াটা মোটা হয়নি। আপনার মনে আছে, ছোটোবেলায় কি বকা খেতে হত। কথা না শুনলেই বকা। সারাক্ষণ "আমার কথা শোনো," অথবা, "এমন ভান কোরো না যে তুমি আমার কথা শুনতে পাওনি," কিংবা "Pay Attention!" এসব দিয়েই তৈরি হয়েছে শৈশব। তাই শুনতে বাধ্য ছিলাম। মন দিয়ে শুনতে হত বড়দের কথা। না হলেই কার্সিভ রাইটিং এর খাতায় একশ বার লিখতে হত, I am sorry I did...
এভাবেই লোকের কথা শোনাটা আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। শুধু কথার কথা নয়, কী বলা হচ্ছে সেটাও। আর এই অভ্যেসটাই আমার জন্যে খুব বিপজ্জনক হয়েছে। সবার কথা শুনেছি। এতটাই, যে চারধারের মানুষের কথা গুলোর আওয়াজে নিজের কথাই শোনা হয়নি।
আমার মনে আছে, এই স্টার্টআপের প্রথমদিকের সময়গুলোতে এক ভদ্রলোক আমাকে শুধু কথা দিয়েই কাঁদিয়ে দিয়েছিল। এত তিতকুটে কথা। এত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা ছিল লোকটার যে আমি দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলাম আর হাপুস নয়নে কেঁদেই দিলাম। জানতাম যা বলেছিল লোকটা সেটা আমাকে আঘাত করতেই বলেছিল। সভ্যতার সীমা অতিক্রম করেই... তবু সবটা আমার ভিতর গেল। পাকিয়ে কান্না হয়ে বেরিয়ে এল। আমার বাবা ফোন করেছিলেন তখন। কান্নার গলা ঝেরে আমি ভান করছিলাম সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু বাবা তো বাবাই হয়। ওরা সব টের পান। জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে। আমি তো আর দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসব না বাবার কাছে। বললাম যেটুকু ঘটেছে সেটুকুই। বাবা একটা কথা বলেছিলেন।
"দেখো শ্রদ্ধা, তুমি যখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো তখন তুমি নিশ্চয়ই জানবে কীভাবে রাস্তাটা পেরতে হয়। এবং তোমার দিকে ধেয়ে আসা গাড়ি গুলোকে কিভাবে এড়িয়ে যেতে হয়।"
বুঝলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা পেরোতে শিখেছি কি? হয়তো আগের তুলনায় ভালোই রাস্তা পেরোই। কিন্তু তবুও এখনও পাগল করা এই জনস্রোত, গাড়ির হর্ন, ওভারটের ব়্যাস ড্রাইভ আমার রাস্তা পেরনর স্কিলগুলোর কঠিন কঠিন পরীক্ষা নেয়।
তবু যারা চান চামড়াটা মোটা করতে তাদের জন্যে বলতে পারি, সবার আগে নিজের চামড়াটা জন্মগতভাবে মোটা না হওয়ার জন্য, চামড়া মোটা হওয়ার প্রবণতা না থাকার জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিন। হয়ত কেউ কেউ আপনার হদয়বৃত্তির জন্যে আপনাকে এড়িয়ে যাবে, কম নম্বর দেবে। শক্তিশালী বিজনেস লিডার হিসেবে আপনাকে দেখবে না। আমি বলছি কুছ পরোয়া নেহি। কারণ আপনি স্পর্ষকাতর এটা আপনার দুর্বলতা নয়। মনে রাখবেন এটা আপনার শক্তি। ভাগ্যিস আপনি মোটা চামড়ার নন।
তাই সবার আগে নিজের কোমল স্বত্তাকে ভালোবাসুন। কারণ চামড়াটা মোটা এই কঠিন পৃথিবীতে এমনি এমনি হয়ে যায়। আপনাকে যে মন্দ কথা বলছে, আপনার সঙ্গে হৃদয়হীনের মত আচরণ করছে তাঁকে তাচ্ছিল্য করুন। বরং তাকেও উল্টে ভালোই বাসুন কারণ তাঁর দৌলতেই আপনি ভিতরে ভিতরে কঠিন হচ্ছেন।
প্রত্যেকটা অবজ্ঞা, প্রতিটি তাচ্ছিল্য, প্রতিটি প্রত্যাখ্যান আপনার চামড়াটা মোটা করে দিচ্ছে।
তাই আপনাকেও চামড়া মোটা হওয়ার আন্তরিক অভিনন্দন।