নবদুর্গা এখন গ্রামীণ ভারতের রান্নাঘরের ‘অক্সিজেন’
ভারতে এখনও কোটি কোটি মহিলা রান্নাঘরের দমবন্ধ করা বিষাক্ত ধোঁয়ায় কষ্ট পান। ফলে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস আর চোখের সমস্যায় ভোগেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১.৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ভারতে গৃহ অভ্যন্তরীণ দূষণের কারণে মারা যান। এই মৃত্যুর পিছনে মূল কারণই হল কঠিন জ্বালানি। যেমন – জ্বালানি কাঠ, ঘুঁটে। যা উনুনে রান্নার জন্যে ব্যবহৃত হয়, এইসবের থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া বা গ্যাস। শরীরের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ছাড়াও এই উনুনের জন্যে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করতে বা ঘুঁটে তৈরি করতে প্রচুর সময়ও নষ্ট হয়। ভারত সরকারের ‘শক্তি পরিসংখ্যান ২০১৩’ রিপোর্ট অনুযায়ী ৮০০ মিলিয়নেরও বেশি ভারতীয় প্রথাগত পদ্ধতিতেই রান্না করেন।জ্বালানি কাঠ, কাঠ কয়লা, তুষ, ঘুঁটে ইত্যাদির সাহায্যে। যে সকল গৃহস্থের বাড়িতে কেরোসিন ব্যবহার হয়, তাদেরকে আয়ের ৩০ শতাংশ এর জন্য ব্যয় করতে হয়।
২০০৯ সালে এই সমস্যার সমাধান করতে সৌরভ সাগর জয়সওয়াল এবং তাঁর বাবা অরবিন্দ সাগর জয়সওয়াল ‘নব দুর্গা মেটাল ইন্ডাস্ট্রিস’ তৈরি করেন। সংস্থা তৈরির পিছনে মস্তিষ্ক ছিল সৌরভের শ্বশুরমশাই মহেন্দ্রপ্রতাপ জয়সওয়ালের। নেপালে তিনি এক গরিব চাষিকে তুষের আগুনে উনুন জ্বালাতে দেখে প্রথম এ ধরনের উনুন তৈরির কথা ভাবেন। নব দুর্গার প্রথম প্রোডাক্ট, ‘জনতা চুলহা স্মোকলেস’-র দাম ছিল ৫০০ টাকা।
‘আমাদের মনে হয়েছিল যে রান্নার উনুনের উন্নতি হলে এই ধরনের সকল পরিবারের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে বিশেষ উপকার হবে এবং সামগ্রিকভাবে তা প্রভাব বিস্তার করবে। আমাদের এই স্টোভ তাদের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা দেবে এবং তাদের আয় বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। জ্বালানি সংগ্রহের জন্য তাদের আর ভাবতে হবে না। অনেকটাই সময় বাঁচবে, ফলে তারা উপার্জনের দিকে অধিক মনোযোগ দিতে পারবেন। এই স্টোভগুলি পরিবেশের জন্যেও স্বাস্থ্যকর।’’ - বললেন বিভোর জয়সওয়াল, মহেন্দ্রবাবুর পুত্র। তিনি এই কোম্পানিতে ২০১২ সালে যোগ দেন একজন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে। বিভোর হিউম্যান রিসোর্স-এর নিয়ে এমবিএ করেছেন এবং তার আগে স্পাইসজেট এয়ারলাইন্স ও অন্যান্য নানা ধরনের প্রজেক্টে কাজ করেছেন সারা ভারতে। তাঁর বাবার স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং নব দুর্গা কোম্পানিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই জীবনের পথ বলে মনে করেন।
বিভোরের আগমনে নব দুর্গা কোম্পানি নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়। তিনটে রাজ্যে আটকে না থেকে আরও আটটি রাজ্যে এই সংস্থার ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। প্রাথমিক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে বিভোর নব দুর্গাকে নানা ভাবে সাহায্য করেছেন। যেমন- বিনিয়োগ খুঁজে আনা, তুষের আগুনে রান্নার স্টোভের জন্যে বাজার তৈরি করা, নিম্ন-আয় সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি করা। বিভোর জয়সওয়ালের মতে, নবদুর্গা-র স্টোভ অনেকটাই এলপিজি স্টোভের মতো। একইরকম নীল শিখা তৈরি করে এবং কোনও ধোঁয়া ছাড়াই ৫ সেকেন্ডের মধ্যেই জ্বলে ওঠে। নব দুর্গা এইরকম ১০ ধরনের রান্নার স্টোভ ডিজাইন করেছে যাতে তুষ বা অন্য যে কোনও উদ্ভিজ্জ জ্বালানি ব্যবহার করা যায়। এইভাবে অন্তত ৮০ শতাংশ গৃহ-অভ্যন্তরীণ দূষণ কমানো সম্ভব।
ভারতে প্রায় ১২০ মিলিয়ন টন তুষ তৈরি হয়, যার বেশিরভাগটাই পুড়িয়ে দেওয়া হয় বা আবর্জনা হিসাবে নষ্ট হয়। সম্প্রতি হাস্ক পাওয়ার সিস্টেমের মত কিছু কোম্পানি ধানের তুষকে বিদ্যুত তৈরির কাজে কাঁচামাল হিসাবে কাজে লাগাচ্ছে। নব দুর্গা যে ধানের তুষকে কাজে লাগায় সেটা খুব ভাল ধোঁয়াবিহীন জ্বালানির উৎস। ‘‘খদ্দের-এর মনমতো একটি স্টোভ যোগান দেওয়াটাই ছিল চাবিকাঠি। সময় যত যেতে লাগল, ততই ব্যবসার অন্যান্য বিষয়গুলো সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে থাকলাম। যেমন – মাইক্রো ফিনান্স, বিনিয়োগ, নিত্য নতুন প্রোডাক্টের উন্নতি। ভারতে আমরাই প্রথম তুষের স্টোভ বানিয়েছি এবং বানিয়ে চলেছি। একই সঙ্গে সবার মধ্যে ছড়িয়েও দিতে পেরেছি।’’ বললেন জয়সওয়াল। নব দুর্গার মূল অফিস উত্তরপ্রদেশে এবং এর সঙ্গে বিহার, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিসগঢ়, কর্নাটক, অসম, ও মেঘালয়ের মতো রাজ্যে এর উপস্থিতি।
নব দুর্গা সরাসরি ৩০,০০০ গৃহস্থালির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ওই সংস্থার হিসেব বলছে, তাদের স্টোভ বছরে প্রায় ৬০,০০০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন কমিয়েছে। প্রতিটি অগ্নি রাইস হাস্ক স্টোভ গড়ে প্রায় ২০টি গাছ, ৭৩০ ঘণ্টা সময় এবং ২ টন গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমায় প্রতি বছর। এছাড়াও, এই স্টোভ থেকে যে ছাই পাওয়া যায়, তা মাটির জন্য খুবই উপকারি।
আরও বিভিন্ন কৃষিজ বর্জ্যকে কীভাবে জ্বালানিতে পরিনত করা যায়, নব দুর্গা সেই নিয়ে কাজ করে চলেছে। সম্প্রতি সামাজিক ক্ষেত্রেও অগ্নি মিড ডে মিল স্টোভ এসেছে। এগুলিকে বিশেষভাবে ব্যবহারকারীর সুবিধামতো তৈরি করা হয় এবং বিভিন্ন সাইজের পাওয়া যায়, বিশেষত গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলির জন্য। এই বছরের শেষে নেপালে নিজেদের শাখা বিস্তারের কথা ভেবেছেন বিভোর। ২০১৬ সালের মধ্যে, নব দুর্গা প্রায় ২,০০,০০০ রান্নার স্টোভ তৈরি করবে, বিক্রি করবে এবং ছড়িয়ে পড়বে সারা ভারত জুড়ে। আর এভাবেই একটু একটু কমবে রান্নার দূষণের তেজ। হেঁশেল গিয়ে চোখের জল আর মুঝতে হবে না মায়েদের।