নাটাগড়ের 'আর্ট হাট'-এ অরুণার শিল্পীত লড়াই
মুখার্জি পরিবারের সবথেকে ছোট মেয়ে বুবুলা। তিন দাদা আর এক দিদির পর পরিবারের ছোট মেয়ে সবার কাছেই বেশ আদরের। সপ্তাহান্তে বাবার পাকাচুল বেছে দিলেই প্রমথনাথের মিষ্টি খাওয়ার সেই দিনগুলো যেন এখনও চোখে ভাসে পঞ্চাশ পেরোনো এই মানুষটার। গান শেখা, নাচ করা, খেলাধুলা আর পড়াশুনার সাথে বিভিন্ন রকম হাতের কাজেও বেশ দক্ষ। কিন্তু এসব দিয়ে তো আর মেয়েদের জীবনে উন্নতি হয়না, তাই বাবার কথা মতো বিয়ে। শশুড়বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে হেঁসেল সামলানো থেকে শুরু করে সব কাজই সামলাতে হোতো একা হাতে। আর সবের মধ্যেই ছিল নিজের মতো করে বেঁচে থাকার ইচ্ছে। বছর দুয়েক কাটতেই সংসারে এলো নতুন অতিথি। তাকে বড় করার, ভালো করে মানুষ করার ইচ্ছাটা প্রবল হতে থাকে ক্রমশ। সাথে সংসারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো মজবুত করার একটা প্রচেষ্টাও তাকে উদ্বুদ্ধ করে কিছু একটা করতে হবে আর এসব ভাবনা থেকেই জীবন সংগ্রামের যুদ্ধে ঝাঁপ দিয়েছিল বাপ দাদার আদরের বুবুলা। ভালো নাম অরুণা গাঙ্গুলী।
ঠোঙ্গা তৈরি বা ধুপ কাঠি বিক্রি দিয়ে যে লড়াইটা তিন দশক আগে শুরু করেছিলেন, আজ সেটা একটা রূপ পেয়েছে। উনি বলছিলেন যে আসলে সব কাজই তিনি করেছেন মনের আনন্দে। আর তাই আজকে খুলে ফেলেছেন নিজের একটা বুটিক – আর্ট হাট। সোদপুরের নাটাগড়ে নিজের একটা দোকান। বুটিকে বিভিন্নরকম ডিজাইনার শাড়ি থেকে শুরু করে কুর্তি বা চুড়িদারের পিস সবই পাওয়া যায়। এখানে কিন্তু পুরোটাই হস্তশিল্পের জিনিস। আসলে নিজে হাতের কাজ জানেন। তাই নেশাকে পেশায় বদলাতে চাইলেন বুবুলা। ছেলের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হল। বউমা চাকরি করলেও শাশুড়িকে মাঝে মাঝে সাহায্য করে এই ব্যবসায়। আধুনিক প্রযুক্তির হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে সে ক্রেতা খুঁজে এনেছে দেশের অন্যপ্রান্ত থেকে। সবমিলিয়ে কাজ আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত অরুণা দেবী।
ইওর স্টোরির সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলছিলেন যে জীবনে কিছু একটা করার অদম্য এক ইচ্ছা ওঁর সব সময়ই ছিল। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাকে ঠিক মতো সামাল দিতেই তাঁর এই ব্যবসা শুরু। সালটা ২০০০। দাদা সুব্রত মুখার্জির অনুপ্রেরণাতেই ব্যবসা শুরু করেন। প্রথম দিকে বাড়িতেই ফ্রেম তৈরি করে, শাড়িতে ফেব্রিক বা সেলাইয়ের কাজ চলত। আসতে আসতে বিক্রির পরিধি বাড়তে থাকে, ফলে চাহিদা বাড়তে থাকে, এখন প্রায় দশ থেকে বারো জন কর্মচারী আছেন, যারা বিভিন্ন রকম কাজ করেন। ক্রেতার সাধ্যের মধ্যে তাঁর মনের সাধ মেটানোই হল আসলে অরুণা দেবীর উদ্দেশ্য।
কাহানী আভি বাকি হ্যাঁয় –
ইচ্ছাশক্তি মানুষকে ঠিক কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে তার জীবন্ত নিদর্শন তিনি। ব্যবসার জন্য বিভিন্ন মানুষের সাথে পরিচয় হয়, মেলাতে ইংরাজি বলা মানুষদের সাথে ঠিক করে কথা বলতে গেলে ভাষাটা শেখা দরকার। তাই বছর পাঁচেক আগে স্পকেন ইংলিশ কোর্স করেছেন, বাড়ি থেকে স্টেশন অনেক দূর, এই দূরত্বকে হাতের মুঠোয় আনতে তাই এই বয়সে শিখে ফেলেছেন সাইকেল চালানো। মাথায় একটা টুপি আর রোদ চশমা পড়ে সাইকেল চালিয়েই এখন তিনি পৌঁছে যান বিভিন্ন জায়গায় বেশ সাবলীল ভাবেই। সোদপুর থেকে কলকাতায় গিয়ে সাঁতার শিখেছেন এই তো সবে কিছুদিন হল। সেখানে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। বয়সের সাথে সাথে নিজেকে পরিপূর্ণ করেছেন অরুণা। ছোটবেলায় সুযোগ না পাওয়া বা অপূর্ণ শখগুলো পূরণ করতে চেয়েছেন তিনি। বাচ্চাদের নিয়ে মাসে একবার করে ঘরোয়া গান বাজনার আসর করেন। বলছিলেন যে সব বাচ্চা সবার সামনে কিছু করতে চায়, আজকাল পড়াশুনার চাপে ওদের একটু হালকা মনে গান, কবিতার জায়গা করে দেওয়াই আমার লক্ষ্য। পাড়ার বাচ্চারাও পিসির কাছে এসে অনেকটা সাবলীল, মন খুলে গল্প করা যায় পিসির সাথে। কিন্তু এসবের পেছনে প্রাথমিক উৎসাহ পেয়েছিলেন স্বর্গীয় দাদার কাছ থেকেই। তাঁর অনুপ্রেরণাতেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন জীবনের অন্য এক মানে।
বলছিলেন, সরকারি হস্তশিল্প উদ্যোগীদের দলে নাম রয়েছে ওঁর। তাই সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন মেলায় স্টল দেওয়ার সুযোগ পান। এছাড়াও রয়েছে সারাবছরের কিছু নির্দিষ্ট ক্রেতা। সবমিলিয়ে মোটামুটি ভালই চলে যায় তাঁর শিল্পীত কুঁড়েঘর।