ঘুটে কুড়ুনি থেকে কোটিপতি হওয়া কল্পনা
কল্পনা সরোজ। হতদরিদ্র পরিবারের গ্রাম্য বধূ থেকে আজ মুম্বাইয়ের কোটিপতি ব্যবসায়ী। একসময় আক্ষরিক অর্থেই ঘুটে কুড়ুনি ছিলেন। শোষণের শিকার হয়েছেন। বাল্য বিবাহের, সাংসারিক অত্যাচারের, জাত পাত সংক্রান্ত কুসংস্কারের শিকার হওয়া কল্পনা সরোজ কেবলমাত্র নিজের উদ্যোগে, অসীম সাহসে ভর করেই আজ সাফল্যের শীর্ষ ছুঁয়েছেন।
কল্পনার জন্ম মহারাষ্ট্রের অকোলা জেলার রোপড়খেড়া গ্রামে। বাবা ছিলেন পুলিসের হাবিলদার। মা গৃহবধূ। তিন ভাই তিন বোনের সংসার। পরিবারের বড় মেয়ে কল্পনা। বাবার আদরের মেয়ে। কল্পনার ঠাকুর দাদু অন্যের খেতে দিনমজুরি করতেন। লেখা পড়া জানতেন না। তাই তিনি চেয়েছিলেন কল্পনার বাবা কাকাদের লেখা পড়া শেখাতে এবং দিনমজুরির অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে। সেই মত কল্পনার বাবা মহাদেব ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশুনো করেন। অতি কষ্টে পুলিশের চাকরিও জুটে যায়। সেই সুবাদে পুলিশ লাইনে থাকার বন্দোবস্তও।
কিন্তু কল্পনা জানাচ্ছেন জাতপাতের অত্যাচার পুলিশ লাইনে কিছু কম ছিল না। উঁচু জাতের লোকেরা নিচু জাতের পরিবারের সঙ্গে বাচ্চাদের মিশতেই দিত না। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে আসা জাতপাত সংক্রান্ত অসম্মান কল্পনা স্কুলে পড়ার সময়ও পেয়েছেন। শিক্ষিত টিচারদের কাছ থেকে।
লেখা পড়া, বুদ্ধিশুদ্ধি, খেলাধুলো, সাংস্কৃতিক অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই উঁচু জাতের ছেলেমেয়েদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন কল্পনা। উৎসাহও ছিল। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাঁকে অনুপ্রাণিত তো করেনইনি বরং একটি সুযোগও পেতে দেননি। তবু বাঁচোয়া পুলিশ লাইনে থাকতেন। কল্পনার বক্তব্য, যদি গ্রামে থাকতে হত তাহলে লেখাপড়া কিছুই শেখার সম্ভাবনা ছিল না। কারণ ওরা দলিত জাতির মানুষ। আর গ্রামের উঁচু সম্প্রদায়ের লোকেরা মানুষ বলেই ওদের গণ্য করত না। বাবা পুলিশের চাকরি পাওয়ার পর ঠাকুরদাদাও চলে আসেন পুলিশ লাইনেই। গ্রামের নানা গল্প বলতেন ঠাকুর দাদা। কল্পনাকে গ্রাম ভীষণ টানত। একবার স্কুলের ছুটিতে কল্পনা তাঁর ঠাকুরদাদার সঙ্গে গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর ঠাকুর দাদার সঙ্গে লোকজনের ব্যবহার মনে দাগ কাটল। কেউ ঘরে ঢুকতে দেয়নি। ভাঙা পরিত্যক্ত বাসনে জল দিয়েছে। ফেলে দেওয়া মাটির খুড়িতে চা। ছায়া পর্যন্ত মাড়াতে অস্বীকার করেছে গ্রামের তথাকথিত উঁচু মানুষেরা। এসব দেখে কল্পনা অসম্মানিত বোধ করেছিল। শিশু মনে সমাজের জাতি বিদ্বেষের ছবিটা গেঁথে গিয়েছিল।
শুধু যে জাতপাতের যন্ত্রণা সইতে হয়েছে তা নয়, সঙ্গে ছিল দারিদ্রেরও কঠিন সময়। বাবা একা রোজগেরে। কাকা পড়াশুনো করতেন। পিসি মাঝে মধ্যেই চলে আসতেন, দীর্ঘসময় থেকে যেতেন, তাঁর পরিবারেও নানান সমস্যা ছিল। এছাড়া ঠাকুর দাদা থাকতেন। দু কামড়ার ঘরে একটি মাত্র কামড়া পড়েছিল বাবা মা আর ছয় ভাইবোনকে নিয়ে থাকার জন্য। পুলিশ লাইনের সরকারি ঘরে থাকতে পয়সা লাগত না ঠিকই কিন্তু বাবার মাইনে তখন ছিল মাত্র তিনশ টাকা। ভাবছেন তো তিনশ টাকায় তখন অনেক কিছু হওয়ার কথা, মানছি। কিন্তু বারো জনের সংসার চালানোর জন্যে, তাদের দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতেই এই টাকায় টানাটানি হত।
বাবাকে সাহায্য করতে ছোট্ট কল্পনা সিদ্ধান্ত নেন তিনি কাজ করবেন। স্কুল থেকে ফিরেই চলে যেতেন জঙ্গলে সেখান থেকে কাঠকুটো নিয়ে আসতেন। ঘরে জ্বালানির জন্যে। কিংবা বিক্রি করে পয়সা জোগাড় করতে লেগে যেত সেই কাঠকুটো। ছোটবেলা থেকেই ক্ষেতের কাজ শিখে ফেলেছিলেন। ফলে টাকার জন্যে অন্যের ক্ষেতের ঘাস কাটা, বাদাম পারা, কার্পাস তুলো বাছাই করার কাজ করতে শুরু করে দিলেন। পাশাপাশি গোবরের ঘুঁটে দিয়ে সেই ঘুঁটে বিক্রি করেও পয়সা রোজগার করতেন কল্পনা। এভাবে ৫০ পয়সা একটাকা যাই পেতেন সেই টাকায় নিজের পড়াশুনোর খরচ চালাতেন। বান্ধবীদেরও বোঝাতেন এই ভাবে তারা তাদের পরিবারের সহযোগিতা করতে পারে। অনেক মেয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে গোবর সংগ্রহের কাজ করত, বাড়িতে বকুনিও খেত। সেসময় পাঁচ পয়সায় ডবল রুটি পাওয়া যেত। একটা ডাবল রুটি দিয়ে তিন বোনের পেট ভরে যেত। গাছে চড়তে পারতেন। ফল পারতেন। বিশেষ করে তেঁতুল আর কুল গাছে নজর ছিল বেশি।
ছোটবেলা থেকেই বেশ ডাকাবুকো সাহসী ছিলেন তিনি। তাই স্বপ্নও দেখতেন বড় হয়ে পুলিশ হবেন, কিংবা মিলিটারিতে যাবেন। বড় সেনা কর্তা কিংবা পুলিশ অফিসার হবেন। কিন্তু কোনও স্বপ্নই সফল হল না। মাত্র বারো বছর বয়সেই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। খুব কেঁদেছিলেন। বাবা মা ঠাকুরদাদা সবাইকে বলেছিলেন বিয়ে নয়। পড়তে চান। কেউ কান দেননি। বিশেষত মা আর মামা। মামা বলতেন, "মেয়েরা বিশের পুটলি। তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে হয়। লেখা পড়া করে হবেই বা কী! সেই তো শ্বশুরবাড়ি গিয়ে হেঁশেল ঠেলতে হবে। তা যত আগে সেটা আয়ত্ত করবে ততই ভালো।" অল্প শিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত আর ধ্রুপদী গ্রাম্য দলিত ছিলেন মামা। কল্পনা যখন ক্লাস ফাইভে পড়তেন তখন থেকে সম্বন্ধ আনা শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। ঘোর আপত্তি ছিল মহাদেবের। কিন্তু ও যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে তখন মুম্বাইয়ের এক পাত্রের হদিস আনলেন মামা। মুম্বাই, মহারাষ্ট্রের গ্রাম গঞ্জের মানুষের কাছে মুম্বাই মানে তখন যেন আমেরিকা। সমস্ত সমৃদ্ধি যেন সেখানেই কুক্ষিগত। ফলে আর না করতে পারলেন না মহাদেব। বিয়ে হল। বেআইনি বিয়ে। বারো বছরের মেয়ের বিয়ে যেকোনও আইনেই অপরাধ। পুলিশের হাবিলদার হয়েও অপরাধটা সামাজিক চাপে করতে বাধ্য হলেন মহাদেব।
শুরু হল মুম্বাইয়ের জীবন। লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেল। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরও একগুচ্ছ সমস্যা। প্রতারণা। প্রবঞ্চনা। মিথ্যাচারের শিকার হলেন কল্পনা। যা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। বলা হয়েছিল শ্বশুরবাড়িতে অনেক আদর যত্ন পাবেন। ভালো বর, ভালো ঘর। কিন্তু মুম্বাই এসে দেখেন থাকার জায়গা মানে ঝোপর পট্টি। নোংরা আবর্জনাময় বস্তি। একটা মাত্র ঘর সেখানেই গোটা শ্বশুরবাড়ির সমস্ত সদস্য থাকেন খান ঘুমান। চার দিক থেকে দুর্গন্ধ। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। তার ওপর ছিল ভাসুর, জায়ের অত্যাচার। কথায় কথায় মাথার চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে গলায় পা দিয়ে রগড়ে মারা হত। খাবার সময় খেতে দেওয়া হত না। অশ্রাব্য নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করা হত। বারো জনের পরিবারের সকলের সব কাজ তাকেই করতে হত। ভাসুর জা লোকের বাড়ি বাসন মাজা ঘর মোছা আর কাপড় কাঁচার কাজ করত। ফিরে এসে রোজ মারত কল্পনাকে।
মেয়ে কেমন আছে দেখতে এলেন বাবা। কিন্তু তাও মাস ছয়েক পর। ততদিনে দিনের পর দিন মার খেয়ে, অত্যাচারে অপমানে চেহারাই বদলে গিয়েছিল কল্পনার। এতটাই বদলে গিয়েছিল যে মহাদেবের চিনতে অসুবিধেই হয়। অনেক জদ্দোজহেদ করে ফিরিয়ে আনেন মেয়েকে। তারপর শুরু হয় পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজনদের ঠেস দেওয়া কথা। জীবনটা হেল হয়ে যায় কল্পনার। কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। হাসপাতালের চিকিৎসকরা একরকম আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ বেঁচে যান। তারপর শুরু হয় আরেক প্রস্ত হেনস্তা। মনমরা, হতোদ্যম মেয়েটা একদিন স্থির করেন না আর মরবেন না। এবার মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে জ্বলে উঠবেন। আত্মবিশ্বাস সঞ্চয় করে স্থির করেন আবারও মুম্বাই যাবেন। তবে স্বামী ভাসুরের ঘর করতে নয়। নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
আত্মহত্যার মুখ থেকে সবে ফিরে আসা মেয়ে। মা ছাড়তে চাইছিলেন না। কিন্তু মুম্বাইয়ে কাকা থাকতেন। দাদরে। সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মা বাবা আসেন মেয়েকে পৌঁছে দিতে। কাকা স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। নিজে একটি পাঁপড়ের কারখানায় কাজ করতেন। ভাইঝিকে দেখভাল করার মতো কোনও বন্দোবস্তই ছিল না। তাই তার পরিচিত একটি গুজরাটি পরিবারের দ্বারস্থ হন। ওই পরিবারের সকলেই কল্পনাকে নিজের মেয়ের মতই দেখতেন। ওদের সাহায্যেই একটি হোশিয়ারি কারখানায় কাজ পান কল্পনা। প্রথমে দড়ি কাটার কাজ। দিনে দুটাকা মজুরি। কিছুদিন যেতে না যেতেই সেলাই মেশিনে বসার সাহস পেয়ে যান। সেই মত সেলাইয়ের কাজ আরও ভালো করে শিখে আরও বেশি রোজগারের বন্দোবস্ত করেন তিনি। এবার ২২৫ টাকা মাস মাইনে।
এরই মধ্যে বাবার পুলিশের চাকরিটা চলে যায়। পুলিশ লাইনের কোয়ার্টার ছাড়তে বাধ্য হন। মাকে লোকের ক্ষেতে মজদুরি করতে বাধ্য হতে হয়। বোনেরা সব মাটির সঙ্গে কথা বলছে। ভাইদের স্কুলে যাওয়ার বয়স। বড় বলতে একা কল্পনা। এতটাই বড় হয়েছেন যে গোটা পরিবারকে মুম্বাই ডেকে নেন। থাকার জন্যে দু কামরার একটি বাড়ি ভাড়া করেন। সেখানেই উঠে আসে গোটা পরিবার। আর হোশিয়ারি ফ্যাক্টরির রোজগারের টাকা টিনে জমিয়ে রেখেছিলেন ওই আশ্রয়দাতা গুজরাটি পরিবারের বড় কর্তা। সেই টাকা আর কাজ দিয়ে মোটের ওপর ঠিকই চলত। সুখ ছিল। কিন্তু এরই মধ্যে কঠিন অসুখে কল্পনার এক বোন মারা যায়। শুধু মাত্র দারিদ্রের কারণে, ভালো চিকিৎসা না দিতে পারায় ষোলো সতের বছরের বোনটা মারা গেল কল্পনার। মৃত্যুর আগে কল্পনার কাছে বাঁচানোর কাকুতি মিনতি করেছিল ছোট্ট বোনটা। কিন্তু অসহায়ের মত কিচ্ছু করতে পারেননি কল্পনা।
সেই সময় থেকেই অপরাধ বোধে ভুগতে থাকেন কল্পনা। দারিদ্র না থাকলে হয়ত বোনটাকে বাঁচাতে পারতেন। টাকা তাই চাই। ধনী হতে হবে এই শুরু হল উদ্যোগপতি হওয়ার অভিযাত্রা। দেড় দুবছর টানা সরকারি ঋণের জন্যে ব্যাঙ্কের দরজায় দরজায় ঘুরপাক খেয়েছেন। জুতোর সোল ক্ষয়ে গেছে। এবং ঋণের টাকা না পাওয়া পর্যন্ত থামেননি। সেই সময় ৫০ হাজার টাকা ঋণ পান। সেই টাকা দিয়ে তৈরি করেন তাঁর আসবাব পত্রের ব্যবসা। এবার ভাবলেন সমাজের জন্যেও কিছু করা উচিত। স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে ঘুঁটে কুড়ানোর মন মানসিকতা নিয়েই শুরু করলেন তাঁর নতুন উদ্যোগ, বেকার হতাশ যুবক যুবতীদের সংঘবদ্ধ করে তাদের উদ্যোগী করে তোলার মহান ব্রত নিয়ে ফেললেন কল্পনা। সংগঠনের নাম দিলেন সুশিক্ষিত বেরোজগার যুব সংগঠন। এই সংস্থার মারফত নানান প্রশিক্ষণ শিবিরে আয়োজন করতে শুরু করে দিলেন। উপকৃত হতে থাকলেন বেকার যুবক যুবতীরা। এই সব কার্যক্রমে ব্যাঙ্কের কর্তাদের, সরকারি সচিবদের আমন্ত্রণ করতে শুরু করেন। যার ফলে বেকার যুবক যুবতীদের ঋণ পাওয়া সোজা হয়ে গেল। যে ঋণ পেতে ২ বছর সময় লেগেছিল কল্পনার এবার তা মাত্র ২ মাসে হয়ে যেত থাকল। ফলে বাড়তে থাকল কল্পনার সংগঠন। আর হতদরিদ্র কল্পনা দরিদ্র যুবক যুবতীর নেত্রী হয়ে উঠলেন। সমাজ সেবী হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করলেন। সকলে তাঁকে "কল্পনা তাঁই" নামে ডাকা শুরু করে দিল। এরই মধ্যে এক ব্যক্তি এলেন, তার কল্যাণে একটি জমি আছে। কিন্তু সিলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী কিছু সমস্যা থাকায় জমিটি বিক্রি করতে চান। কল্পনা ওই জমিটি কিনে নিলেন। কুড়িয়ে কাঁচিয়ে মাত্র একলক্ষ টাকা এবং পরে আরও দেড় লক্ষ টাকায় কিনে নিলেন জমিটি। ওই অসুবিধেয় পড়া লোকটিকে সাহায্য করতেই জমিটি কেনেন কল্পনা। বছর দুয়েক দৌড়াদৌড়ি করে জমিটির সিলিং অ্যাক্ট সংক্রান্ত সমস্যাও দূর হয়। তারপরই ঝপ করে জমিটির দাম বেড়ে হয়ে যায় ৫০ লক্ষ টাকা। ধুলো মুঠি সোনা মুঠি হয়ে গেল কল্পনার। জমিটিতে এবার চাইলেন বিল্ডিং খাঁড়া করবেন। কিন্তু টাকা কোথায়! টাকার জন্যে এক সিন্ধি ব্যবসায়ীর সঙ্গে হাত মেলালেন কল্পনা। ৩৫ শতাংশ অংশীদারিতে তৈরি করলেন বিল্ডিং। কোটিপতি হয়ে গেলেন কল্পনা। কিন্তু কল্পনার শত্রুও ততদিনে জন্মে গিয়েছে। মাফিয়াদের নজরে পড়ে গেলেন ঘুটে কুড়ুনি থেকে কোটিপতি হওয়া এই নারী। তাকে মেরে ফেলার জন্যে সুপারি কিলার লাগানো হয়। কিন্তু যে গ্যাঙকে এই খুনের সুপারি দেওয়া হয় সেই গ্যাঙেরই একজন কল্পনার কাছ থেকে কোনও একসময় সহযোগিতা পেয়েছিল। ফলে গোপনে খুনের ষড়যন্ত্রের কথা কল্পনাকে জানিয়ে দেয় সে। আর পুলিশের সাহায্যে সুপারি যে দিয়েছিল সেই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করাতে পারেন কল্পনা। এবার নিজের নিরাপত্তার জন্যে পিস্তল রাখার আবেদন করেন। সাহসী সিংহের মতো তিনি বলছিলেন, আমাকে মারতে এলে আমার পিস্তলের ৬ টা গুলি আমি ব্যবহার করেই মরবো।
কল্যাণের জমিটা সোনার সম্পদই বটে। শুধু যে কল্পনাকে কোটিপতি করে দিয়েছিল তাই নয়, বিল্ডার হিসেবে ব্যবসা করার সাহসও যুগিয়েছিল। পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসাও শুরু করে দিলেন কল্পনা। কিনে ফেললেন সাঁই কৃপা সুগার মিল। হলেন ডিরেক্টর। বন্ধ হয়ে যাওয়া বিখ্যাত কমানি টিউবস কারখানা কিনে নেন কল্পনা। বিজয় রথের চাকা এগোতে থাকে। কামানি টিউবস কোনও এলি তেলি কোম্পানি ছিল না। রামজি হংসরাজ কামানির তৈরি করা গান্ধিজির অনুপ্রেরণায় দেশিয় সংস্থা হিসেবে ১৯৪৫ সালে ভারতের উদ্যোগের মানচিত্রে একটি উজ্জ্বল তারা ছিল এই কামানি গ্রুপস। ১৯৬৬ সালে কুর্লায় তৈরি হয় এই টিউব ফ্যাক্টরি। কিন্তু কামানিদের পারিবারিক গোলযোগ, কর্মচারীদের বিক্ষোভে এই সংস্থা ধুঁকতে থাকে। ১৯৯৭ সালেই ১১৬ কোটি টাকা লোকসানে চলছিল সংস্থাটি। ২০০৬ সালে কল্পনা সরোজ যখন কোম্পানি অধিগ্রহণ করেন তখন কোম্পানি মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু তাঁর উদ্যোগে সংস্থার দিন ফিরতে থাকে। লোকসান কাটিয়ে লাভের দিকে নিয়ে যান কল্পনা। তাঁর চিন্তাধারা, এবং বুদ্ধিমত্তায় ভর করেই ধুঁকতে থাকা কামানি টিউবস ঘুরে দাঁড়ায়। এবং এই ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন কল্পনা সরোজ। এই কোম্পানি চালানোর প্রস্তাব যখন পান, তখন একে সামাজিক উদ্যোগ হিসেবেই দেখেছিলেন কল্পনা। বিআইএফআর এ চলে যাওয়ার পর যখন কোম্পানিটা বিক্রি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, তখন কারখানার শ্রমিকেরা দ্বারস্থ হয়েছিলেন কল্পনার। বোর্ড অব ডিরেক্টরসও কারখানা চালানোর দায়িত্ব দিতে চাইল কল্পনাকে। রাজিও হয়ে গেলেন কল্পনা। সেই থেকে সংস্থা লোকসান থেকে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটা খুব একটা সোজা ছিল না। প্রথমে তিনি একটি এক্সপার্ট কমিটি তৈরি করান। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি হওয়া কমিটির দেওয়া পরামর্শের ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। জানা যায় ১১৬ কোটির ধার আছে কোম্পানির ঘাড়ে। তার সুদের যা চাপ তাতে কখনওই মাথা তোল সম্ভব নয়। এই ধারের টাকা মোকুব করার ক্ষমতা কোনও ব্যাঙ্কের শীর্ষ কর্তার কম্ম নয়। ফলে সোজা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে চলে গেলেন কল্পনা। সোজা কথা। কামানি টিউব একটি ঐতিহাসিক সংস্থা। সম্প্রতি খুবই সঙ্গিন পরিস্থিতি। এই অবস্থায় ধারের সুদ যদি মকুব না করা হয় তাহলে কোম্পানি বাঁচানো সম্ভব হবে না। প্রথমত সুদ মকুব করতে হবে। দ্বিতীয়ত যেসব জরিমানা হয়েছে সেগুলোও মকুব করতে হবে। না হলে কোম্পানিটিকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সংস্থাটাকে বাঁচানো গেলে ধারের টাকা শোধ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। আর যদি তা না হয় তবে কোর্ট সংস্থাটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করবে। ফলে ঋণদাতারা একটা পয়সাও পাবেনা। কল্পনার যুক্তি মেনে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। সে একরকম জয়ই ছিল। আইডিবিআই ব্যাঙ্কও কামানি টিউবসের মূল ঋণের পরিমাণ থেকে ২৫ শতাংশ ছাড় দিল। ফলে আরও অক্সিজেন পেলেন কল্পনা। বিভিন্ন আদালতে চলতে থাকা মামলাও সামলানোর চেষ্টা শুরু করলেন। এক এক করে সব মামলায় জয়ী হলেন কল্পনা। এর মধ্যে ২০০৬ সালে সংস্থাটির জন্যে বিনিয়োগকারী খুঁজতে থাকে ব্যাঙ্ক। আইনি প্রক্রিয়ার অংশীদার হিসেবে কল্পনা এবার কিনেই ফেললেন কামানি টিউবস। হলেন চেয়ারপার্সন। ফলে নতুন উদ্যোগ নিয়ে শুরু হল কল্পনার কাজ। সাত বছরে ধার চোকানোর নির্দেশ দিল কোর্ট। তার অনেক আগেই চুকিয়ে দিলেন ধার। ছ মাসের মধ্যে এতদিন ধরে আটকে থাকা শ্রমিকদের মাইনেও কয়েক মাসেই চুকিয়ে দিলেন। একেবারেই হেরে যাওয়া একটা ম্যাচ শেষ ওভারে যেন দুর্দান্ত খেলে জিতিয়ে দিলেন কল্পনা।
লাভের মুখ দেখল সংস্থা। ঠানেতে তৈরি হল আরেকটি কারখানা। শ্রমিকরা শুধু মাইনেই নয়, পেলেন ইনসেন্টিভ, বোনাস, প্ৰভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন। শ্রমিকদের পরিবারের জন্যে স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থা করলেন তিনি। শ্রমিক কর্মচারীরাও জান লড়িয়ে দিল কল্পনার জন্যে। কামানি টিউবস শুধু দেশের বাজারে ফের চাহিদার শীর্ষে উঠে এলো তাই নয়, বিদেশের বাজারও ধরে ফেললেন কল্পনা। কেবল মাত্র সততা, মানবিকতা, সাহস আর পরিশ্রমের সঙ্গে কল্পনার ব্যবসায়িক মেধা এবং সুযোগের সদ্ব্যবহার করার মতো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব একটি ইতিহাস তৈরি করল। একটি ঘুঁটে কুড়ুনি মেয়ে সাফল্যের এভারেস্ট ছুঁয়ে ফেললেন।