বই মানুষের খাদ্য। ইদানীং অনেকেই মোবাইলে বই পড়েন। ইবুক। আমার এক বন্ধু ইন্টারনেট থেকে বইয়ের পিডিএফ নামিয়ে নামিয়ে হার্ড ডিস্কে আস্ত লাইব্রেরি বানিয়ে ফেলেছিলেন। এখন তো কিন্ডেলও বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। সেখানে কিছু বিনেপয়সায় বই পড়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু সেখানে ইবুক মানেই সবটা ওরকম ফ্রি ডাউনলোড নয়। বই কিনতে হয় কার্ড দিয়ে। তবে হ্যা ভারচুয়াল দোকানে বাংলা বইয়ের দারুণ আকাল। এসব যাদের আয়ত্তের বাইরে তারাও মন দিয়ে বই পড়েন।বই পড়ার অভ্যাস কমলেও এখনও বহু মানুষ আছেন, যাঁরা নিয়মিত বই হাতে পেলেই পড়েন। এঁদের অনেকেরই বইয়ের যেরকম খিদে সেইমতো বই কেনার সাধ্য নেই। তাই পুরনো বই কম দামে কিনতে ধুলো ঘাটেন রোজ। এ দৃশ্য আপনি যেকোনও দিন মেডিকেল কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে স্যান্ডউইচ হয়ে যাওয়া রাস্তায় গেলে দেখতে পাবেন। আর পাবেন শিয়ালদহ স্টেশনের ব্রিজের তলায়। বা মহাত্মাগান্ধি রোডে। পথ চলার ফুটপাথে বেড শিট বিছিয়ে তার ওপর ঢেলে দেওয়া হয় চটি, মোটা, পুস্তানি ছেঁড়া ভালো বই। ধুলো মাখা। উইয়ে কাঁটা। নতুন বইয়ের দাম যে হারে চড়া, তাতে ইংরেজি বা বাংলা দুটি ভাষার ক্ষেত্রেই একটি নতুন বইয়ের টাকায় দুটি বা তার বেশি পুরনো বই কেনা যেতে পারে।
কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় পুরনো বইয়ের মোট ৬০টি ফুটপাথ দোকান আছে। সারা বছর পুরনো বই বিক্রি করেই জীবনযাপন করছে ৬০টি পরিবার। জানা গেল,পুরনো বই বিক্রির কোনও মরসুম নেই। গোটা বছর ধরেই পুরনো বই বিক্রি হয়। মূলত, সাহিত্যের বই লোকে বেশি কেনে। ক্রেতাদের ভিতর সব ধরনের বইপড়ুয়া মানুষ আছেন। কলকাতার বাইরের জেলাগুলি থেকেও পাঠক এসে পুরনো বই কিনে নিয়ে যান। মফঃস্বল বা গ্রামাঞ্চলের পাঠক-পাঠিকাই বেশি। বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য ছাড়া নানা বিষয়ের পুরনো বই বইপাড়ার ফুটপাথে ঢালাও বিক্রি হয়। পাঠক হাতে তুলে তুলে দেখেন। পুরনো বই নিয়ে দোকানির সঙ্গে দরদাম করাটা পাঠকজনোচিত ভদ্রতা কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বই মূলত একটি পণ্য। সেটি লাভজনক হলে লেখক তো বাঁচবেনই, এছাড়া এই ব্যবসার সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত কয়েকশো মানুষও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন।
কলেজস্ট্রিটে আলাপ হল পঞ্চানন দাসের সঙ্গে। ও ওই ৬০ জনের একজন। পঞ্চানন বললেন, এটা আমাদের পারিবারিক ব্যবসা। ৬০-৬৫ বছর আগে আমার বাবা ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন। গত কয়েক বছরে কলেজস্ট্রিটে পুরনো বইয়ের দোকানের সংখ্যা বেড়েছে। পুরনো বই যে উপায়ে সংগ্রহ করেন দোকানিরা তার সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের বিশেষ যোগাযোগ আছে। পুরনো বইয়ের দোকানিদের নতুন প্রজন্মের বাবু রায় বলছিলেন, দালালরা আমাদের কাছে পুরনো বই বিক্রির খবরাখবর নিয়ে আসেন। ওঁরাই আমাদের বইয়ের মালিকের কাছে নিয়ে যান। এরপর দরাদরি করে পোষালে বই কিনি। ভালো বই হলে চাদরে ফেললেই হাওয়া। ছোঁ মেড়ে কোত্থেকে ক্রেতা জুটে যাবে কেউ বলতে পারে না। এভাবে বেচতে বেচতে কত লোকের সঙ্গে আলাপ হয় কেউ কেউ তিন বার আমাদের দোকানে এলেই নিজেকে পুরনো ক্রেতা বলে দাবি করে। আর দরাদরি করার সময় বারবার বলতে থাকে তার জন্যে নাকি স্পেশাল দাম হওয়া উচিত। তাজ্জব।
পুরনো বইয়ের দোকানের মতো বইপাড়ার আরেক বিশেষত্ব প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাথ ঘেঁষা শুধুমাত্র চাকরির বইয়ের দোকানগুলি। এই দোকানগুলিরও সূত্রপাত স্বাধীনতার পরপরই। চাকরির বইয়ের এক দোকানি জানালেন, এও তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা। তবে কয়েক বছর হয়ে গেল ব্যবসাটা ভাল চলছে না। কারণ, এখন মফস্বল শহরেই কেনাকাটা করা যাচ্ছে চাকরির বই। তাই বই কিনতে কলকাতায় ছুটে আসার দরকার পড়ে না।
পুরনো বইয়ের দোকানিরা চাকরির পুরনো বইও রাখেন। তবে চাকরির বইয়ের ক্ষেত্রে পুরনোর চেয়ে নতুন বই কেনার দিকে ঝোঁক বেশি পাঠক-পাঠিকার। তাই সেগুলি মলিন মুখ করে প্রতিদিন দুপুরে রাস্তায় দাঁড়ায় আর সন্ধে বেলা বেঁধে ছেদে ঘরে চলে যায়। রোজ দাম কমে ওই বই গুলোর।
কিন্তু এত বই আসে কোথা থেকে! বইয়ের জোগানে কখনও টান পড়ে না! জানার দারুণ ইচ্ছে হল। জিজ্ঞেস করলাম সটান। দোকানিরা জানালেন। প্রায়ই ওদের সঙ্গে ইতিহাস নিয়ে বেপরোয়া লোকেদের দেখা হয়, যারা বাপ-ঠাকুরদার স্মৃতি ওজনদরে বেচে দিতে পারলে বাঁচে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় এঁরা কলকাতা ছেড়ে বাইরে থিতু হতে চাইছে, নয়তো ঘর গুছতে গিয়ে হাল ফ্যাশানের আসবাবকে জায়গা দিতে গিয়ে, নতুনের প্রেমে পুরাতনকে ভাসান দিতে তৈরি এক পায়ে খাড়া। অথবা বাড়িটা প্রোমোটারের হাতে ফাইনালি হয়তো তুলে দিচ্ছেন। তাহলে বইগুলোর কী গতি হবে? ওজনদরেই অধিকাংশ সময় বিক্রি হয়। দশটাকা বারো টাকা কিলো... জায়গা ফেরে দামের হের ফের হয়। আর যাঁরা বইয়ের মূল্য বোঝেন তাঁরা বইয়ের দাম অন্যভাবে হাঁকেন। কিন্তু আড়িয়ে তাড়িয়ে পুরনো বই বিক্রি হয়েই যায়। দালালরা বই বিক্রির খোঁজ রাখেন। সারা বছরই এরকম খোঁজ আসে। ফলে, বইয়ের জোগানে কখনও টান পড়ে না।
নতুন বইয়ের ক্ষেত্রে নতুন গন্ধটাই হল সবচেয়ে মজার পাওনা। পুরনো বইয়ের ক্ষেত্রেও তেমন কিছু মজা আছে। তিন-চারজন মালিকের হাত বদলে কোনও কোনও বই হাতে আসে। হয়তো নতুন মালিক বইটি হাতে নিয়ে দেখলেন কোথাও কোথাও মোটা করে কালি দেগে লিখে রেখেছেন পূর্ববর্তী মালিক। নিচে সাল তারিখ। হয়ত উপহার প্রাপক বা প্রেরক কোনও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। যিনি বেচেছেন তাঁর হয়ত কিছুই আসে যায় না। কিন্তু হয়ত আপনি লেখাটা দেখে শিহরিত হলেন। তবে মনে রাখা উচিত, বই আসলে খাদ্য। তাকে অবজ্ঞা করলে বইয়ের ঈশ্বর অসন্তুষ্ট হবেন।