মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সমাজে ফেরাতে চায় 'অন্তরা'

মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সমাজে ফেরাতে চায় 'অন্তরা'

Tuesday December 01, 2015,

4 min Read

"আমি ভালো আছি" একথা বলা সোজা। কিন্তু "আমি হতাশায় ভুগছি" বলতে পারা ততটাই কঠিন। কার দায় কেন সোজা কথা সোজা বলতে পারি না...। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কি আমাদের জীভে ছুঁচ ফুটিয়ে রাখে! ভেবে দেখেছেন কখনও? 

জ্বর, পেটে ব্যথা গা বমি হলে স্কুল, কলেজ, অফিস কামাই করতেই পারি। কিন্তু কারণ যদি হয় মনখারাপ, অভিমান, প্রেমের পথে বাধা পাওয়ায় যদি বালিশ ভেজে? আমাদের সমাজ কি তাতে কান দেয়? অবহেলা, কৌতুক আর টিটকিরি ছাড়া আর কিছুই জোটে না অসুস্থের। সবার আগেই যেটা করা হয় তা হল আইসোলেশন। পৃথক করে দেওয়া। খেলায় না নেওয়া। মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের সাহায্য করার চেয়ে তাদের আরও সমস্যার দিকে ঠেলে দেওয়াই যেখানে দস্তুর, সেখানেই প্রায় ৪৫ বছর ধরে এই মানুষগুলোর সেবা করে চলেছে 'অন্তরা।' মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের ফের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার দীর্ঘ লড়াই লড়ছে এই সংস্থা।

image


১৯৮০ সালে কলকাতার কয়েকজন মনরোগ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসক মিলে 'অন্তরা' নামের একটি সংগঠন তৈরী করেন। শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত এবং আর বি ডেভিসের মতো চিকিৎসক এবং পি এম জন ও ব্রাদার অ্যান্ড্রিউ ছিলেন এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম। এঁদের প্রত্যেকেরই এর আগে প্রায় এক দশক ধরে মাদার টেরিজার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। সত্তরের দশকের সেই অস্থির সময়ে মানুষের মানসিক অবস্থা এবং ক্রমশ মদ, ড্রাগসের প্রতি বাড়তে থাকা আসক্তি শত্রুজিৎ, আর বি ডেভিসদের নাড়া দিয়েছিল। বছর দশেক সরকারি হাসপাতালে এধরণের রোগীদের সঙ্গে কাজ করার পর অবশেষে ১৯৮০ সালে তাঁরা স্থির করেনএই মানুষদের একটা আলাদা জায়গা দরকার। 

গড়ে ওঠে 'অন্তরা'। শুরু হল নির্দিষ্ট একটি হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনাও। কলকাতার অদূরে, বারুইপুরে অন্তরাগ্রাম প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং মাদার টেরিজা। তার দু'বছর পর অর্থাৎ ১৯৮২ সাল থেকে কাজ শুরু করে 'অন্তরাগ্রাম', যা এখন সকলের মুখে মুখে 'অন্তরা' নামেই পরিচিত।

মানসিক অসুস্থতাকে আমরা যত অবহেলাই করি না কেন, আসলে যেকোনও বয়সের যেকোনও মানুষের যেকোনও ধরণের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে তা এই সংস্থার কয়েকটি কেস স্টাডি থেকেই স্পষ্ট।‌

image


বছর পাঁচেকের অনির্বাণ। তাকে বাবা, মা অন্তরায় নিয়ে এসেছিলেন খারাপ ব্যবহার এবং অস্থিরতার জন্য। স্কুল হোক বা বাড়ি, এক জায়গায় কখনওই স্থির হয়ে বসে থাকতে পারত না সে। নিজের প্লেটের খাবার না খেয়ে অন্যের থালা থেকে তুলে খাওয়া, কারও বাড়ি গেলেই সেখান থেকে কোনও জিনিস নিয়ে চলে আসা - এধরণের বেশ কিছু সমস্যা ছিল পাঁচ বছরের ওই শিশুর মধ্যে। তবে অন্তরা-র ৫ সপ্তাহের প্লে থেরাপির পর আজ সে অনেকটাই সুস্থ। অনির্বাণের পাশাপাশি তার মা, বাবাকেও প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছে 'অন্তরা'।

উত্তর ২৪ পরগনার এক গ্রাম থেকে ২৬ বছরের এক গৃহবধূকে নিয়ে আসা হয়েছিল এখানে। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি খাওয়াদাওয়া করছিলেন না। ধীরে ধীরে পরিবারের সকলের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। এমনকী নিজের সন্তানের প্রতিও তাঁর আর আগের মতো মনযোগ ছিল না। অন্তরা-র চিকিৎসকেরা তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন মাসখানেক আগে তাঁর ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু থেকে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ওই গৃহবধূ। কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তি রেখে তাঁর কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। দেওয়া হয় অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট। এখন তিনি অনেকটাই সুস্থ। আর হাসপাতালে থাকতে হয় না। মাঝেমাঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলেই চলে।

একইভাবে ২০ বছরের তরতাজা তরুণ রাহুলকেও নিয়ে আসা হয়েছিল এই হাসপাতালে। বাবার ওষুধের দোকান। সেখানে কাজ করতে করতে নিজেই বেশ কিছু ওষুধে আসক্ত হয়ে পড়েছিল সে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে ড্রাগসের আসক্তি। পড়াশুনো পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল রাহুল। দিনের পর দিন অন্তরা-র চিকিৎসকদের কঠোর পরিশ্রমের পর সুস্থ হয়েছে রাহুল। আজ সে পড়াশুনো করছে। বাবার ব্যবসায় তাঁকে সাহায্যও করছে।

এই প্রত্যেকটি ক্ষেত্রই কিন্তু একে অপরের চেয়ে আলাদা। চিকিৎসার ফলে প্রত্যেকেই সুস্থ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও এঁদের প্রত্যেকের মনে দ্বিধা রয়েছে। তাঁরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে চাইলেও সমাজ কি আরও একবার তাঁদের সুযোগ দিতে তৈরী? সেই প্রশ্নটা থেকেই যায়। সংস্থার প্রেসিডেন্ট কমল প্রকাশ বলছেন, "আমরা সকলেই তো কোনও না কোনও সময়ে অসুস্থ হয়েছি। একটা সময় ছিল যখন- নানাধরনের জ্বর, টিবি, কলেরা, ক্যান্সার-এর মতো অসুখকেও বাঁকা চোখে দেখা হত। আজ তো সেই পরিস্থিতি আর নেই। কাজেই শারীরিক ব্যাধির ক্ষেত্রে যদি এই পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে, তাহলে মানসিক ব্যাধির ক্ষেত্রেও তা সম্ভব।"

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর সমীক্ষা বলছে, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে অবসাদগ্রস্ত দেশ। এই দেশের ৩৬ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনও না কোনও সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। হতাশা এবং অবসাদের পরিমাণ পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি। মানসিক সমস্যার সঙ্গে ল়‌ড়াই করতে না পেরে এদেশে গড়ে প্রতিবছর অন্তত ১ লক্ষ মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন। অথচ এসব সত্ত্বেও আমরা মানসিক সমস্যাকে গুরুত্বহীন বলেই মনে করি। সম্প্রতি নিজের মানসিক বিপর্যয় এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন অভিনেত্রী দীপিকা পাডুকোন। তারপর থেকে এই বিষয়ে চর্চা শুরু হয়েছে সংবাদমাধ্যমেও।

একথা ঠিক, গত কয়েক বছরে এই নিয়ে খানিকটা হলেও ছুঁৎমার্গ কমেছে। তবে এখনও সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে মানসিক অসুস্থতা আসলে পাগলামো, এবং তাঁরা মনে করেন, এই অসুস্থ মানুষগুলো যা করেন, তা তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই ভাবনা বদলাতে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে চলেছে অন্তরা। আরও বহুদিন তারা এই কাজ চালিয়ে যেতে চায়। শুধুমাত্র এই মানুষদের সুস্থ করে তোলাই নয়, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন ঘটানোও তাঁদের লক্ষ্য।