টেনিসগ্রহের এক বাঙালি পরিচালকের কিস্সা
২০১০ র উইম্বলডন। প্রথম রাউন্ডে পুরুষদের সিঙ্গসলে মুখোমুখি আমেরিকার জন ইসনার ও ফ্রান্সের নিকোলাঁ মাহুঁ। সেই বিখ্যাত ম্যাচ। যে ম্যাচ চলেছিল এগারো ঘন্টা পাঁচ মিনিট ধরে। টেনিসের ইতিহাসে দীর্ঘতম। ইসনার-মাহুঁ যুদ্ধ তো রেকর্ড বইতে জায়গা করে নিয়েছে। সেই রেকর্ডের স্বাক্ষী এক বাঙালি। যাঁর নাম হয়তো রেকর্ড বইয়ে নেই । তিন দিন ধরে চলা সেই ম্যাচে চেয়ার আম্পায়ারের দায়িত্বে ছিলেন বাংলার অভিষেক মুখোপাধ্যায়।
২০১৪ এবং ২০১৫ উইম্বলডনে পুরুষদের সিঙ্গলস ফাইনালের মধ্যে মিল কোথায় বলতে পারবেন? দুবারই চ্যাম্পিয়ন নোভাক জকোভিচ। দুবারই ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিলেন রজার ফেডেরার ও নোভাক জকোভিচ। পরিসংখ্যান দেখে একথা সকলেই বলে দেবেন। যেটা অনেকেই জানেন না সেটা হল টেনিসগ্রহের সেই হাইভোল্টেজ ম্যাচে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে শান্ত মাথায় চেয়ারে বসে ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন অভিষেকবাবুই।
কোর্টে লম্বা ব়্যালি (rally) নয় । নয় ব্যাকহ্যান্ড বা ফোরহ্যান্ডের জাদুতে টেনিসবিশ্বকে সম্মোহিত করা। গ্র্যান্ডস্ল্যামের আসরে নোভাক জকোভিচ, অ্যান্ডি মারে, রজার ফেডেরার থেকে সেরেনা উইলিয়ামস, মারিয়া শারাপোভারা অবশ্য তাঁর কথাই শোনেন। তিনি টেনিস গ্রহের বিস্ময় প্রতিভা নন। নন মেন্টরও। তিনি পরিচালক। ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচ পরিচালনার গুরুদায়িত্বে। চেয়ার আম্পায়ার অভিষেক মুখোপাধ্যায়। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, উইম্বলডন থেকে ফ্রে়ঞ্চ ওপেন, ইউএস ওপেন-- চারটি গ্র্যান্ডস্ল্যামেই চেয়ার আম্পায়ারিং থেকে এখন ইন্টারন্যাশনাল টেনিস ফেডারেশনের ম্যাচ রেফারি। ১৮ বছরের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন অভিষেক এখনও ২৮ টি গ্র্যান্ডস্ল্যামে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
এ যেন সেই গলি থেকে রাজপথের কাহিনি অভিষেকের। অভিষেকের শৈশব, কৈশোর কেটেছে পাটনায়। কর্মসূত্রে তাঁর পরিবার পাটনাতেই থাকত। পাঁচ বছর বয়সে টেবিল টেনিসে হাতেখড়ি রামমোহন রায় সেমিনারি স্কুলে। টানা তিন বছর বিহারের নাম্বার ওয়ান। জাতীয় স্তরে তখন পাঁচ নম্বরে অভিষেক। সেই সাফল্য অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। দশম শ্রেণির পরীক্ষার জন্য বাড়ির চাপে ছাড়তে হল সখের টেবিল টেনিস। পাটনার পাঠ গুটিয়ে সপরিবারে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন ওরা। সাল ১৯৯২। ১৫ বছর বয়সে টেবিল টেনিস থেকে টেনিসের ক্লাসে যোগ দেওয়া শ্রীরামপুরে। ৬ মাসের মধ্যেই সল্টলেকের সাইতে আয়োজিত অল বেঙ্গল জুনিয়র টেনিসের সেমিফাইনালে উঠে সকলের নজর কাড়েন। তারপর থেকে সাইতেই টেনিসের অনুশীলন । ১৯৯৫ সাউথ ক্লাবে ডেভিস কাপে লিয়েন্ডার পেজ, মহেশ ভূপতিদের ভারত মুখোমুখি সুইডেনের । বলবয়ের দায়িত্ব পেল সেদিনের কিশোর অভিষেক। আর তাতেই যেন সব বদলে গেল। ডেভিস কাপের সেই ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তখনকার এক নম্বর চেয়ার আম্পায়ার ইংল্যান্ডের মাইক মরিসে । তাঁর সান্নিধ্যেই বলবয় অভিষেকের মনের কোনে উঁকি দেয়, অন্য এক বাসনা । রাকেট (racket) হাতে টেনিস নয়, নয় বলবয় --- চেয়ার আম্পায়ার হওয়ার বাসনা । আর হঠাত ই সুযোগটাও চলে এল। ৯৬ য়ে সাউথ ক্লাবে আয়োজিত ন্যাশনাল টেনিসে আম্পায়ারের দায়িত্ব পেয়ে গেলেন অভিষেক। তারপর ? তার আর পর নেই। সেই শুরু .... তবে সমস্যা একটাই, সেভাবে যে টেনিস আম্পায়ারিং-র পেশাদার কোনও কোর্স করা নেই ? নিজের লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে প্রযোজন পেশাদারি শিক্ষা।
৯৭ এ চেন্নাইয়ে আইটিএফ আম্পায়ার লেভেল ওয়ান পরীক্ষায় প্রথম সুযোগেই পাশ করলেন । পরের দুবছর নিজের পয়সা খরচ করে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় টেনিস আম্পায়ারিং করে গেলেন অভিষেক। পাশে পেয়েছিলেন বেঙ্গল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের মানিক গোস্বামী ও হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়কে। আর ৯৯ এ মুম্বইয়ে হোয়াইট ব্যাজ টেনিস আম্পায়ারিংয়ের কঠিন পরীক্ষায় বাজিমাত। তার পরেই করসপন্ডেন্সে গ্র্যাজুয়েশন ও আই.আই.এস.ডব্লিউ.বি.এম থেকে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট নিযে পেশাদারী কোর্সে পাশ করে ফেললেন।
সাল ২০০৫। গ্র্যান্ডস্লামের দুনিয়ায় অভিষেকের অভিষেক। ঐতিহ্যশালী উইম্বলডন দিয়ে যাত্রা শুরু । ২০০৭ থেকে ইউএস ওপেন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে আম্পায়ারিং। ফ্রে়ঞ্চ ওপেনে অভিষেকের অভিষেক ২০১৪তে। ২০১৪ এবং ২০১৫ তে এক ক্যালেন্ডার বছরে চার চারটি গ্র্যান্ডস্ল্যামেই আম্পায়ার কাম ম্যাচ রেফারির দায়িত্ব সামলেছেন বাংলার একমাত্র উজ্জ্বল নাম অভিষেক মুখোপাধ্যায়। শুধু গ্র্যান্ডস্ল্যামের দুনিয়ায় নিজেকে আটকে রাখেননি । অলিম্পিকের আসরে, এশিযান গেমস এবং কমনওয়েলথ গেমসেও কোর্টের পাশে অভিষেক। ২০০৮ এর বেজিং অলিম্পিকের পর ২০১২ র লন্ডন অলিম্পিক । আর ২০১২ র লন্ডন অলিম্পিকে মহিলাদের সিঙ্লসে গোল্ড মেডালিস্ট ম্যাচ। সেরেনা উইলিয়ামস বনাম মারিয়া শারাপোভা ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন অভিষেক। ২০০৮ এবং ২০০৯ এ ইউএস ওপেনে পুরুষদের সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনিই। আর ২০১২ তে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে পুরুষ ও মহিলাদের সিঙ্গলস ফাইনালে তিনিই ছিলেন চেয়ার আম্পায়ার। সদ্যসমাপ্ত ২০১৬ র অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে মিক্সড ডাবলসের কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করতে গিয়ে বেশ খানিকটা চমক লেগেছে অভিষেকের। কোর্টের দুপাশে দুই ভারতীয়। একদিকে লিয়েন্ডার পেজ-মার্টিনা হিঙ্গিস জুটি। অন্যদিকে সানিয়া মির্জা- ডো ডং জুটি। অভিষেকের গল্প বললে হয়তো শেষই হবে না । মাত্র ৩৭ বছর বয়সে এত সব কিছু করলেন কিভাবে ? অভিষেকের সহাস্য জবাব, সাহস আর আত্মবিশ্বাস থাকলে সব সম্ভব। আসলে ইচ্ছেশক্তিটাই আসল শক্তি। সেই ফাঁকে এটাও জানিয়ে রাখলেন ২০১৫ তে উইম্বলডনের আসরে ফেডেরার খেলা দেখতে গ্যালারিতে বিরাট-কোহলি আর অনুষ্কা শর্মাকে দেখা গিয়েছিল।সেখানেও ট্যুইস্ট। সেন্টার কোর্টে প্রবেশের সেই রাজকীয় ব্যবস্থাও নাকি অভিষেকের হাত ধরেই। ক্রিকেট রোমান্সেও এক টেনিস আম্পায়ারের ছোট্ট ডিশিসন। বিরাট অ্যান্ড অনুষ্কা- কট অ্যান্ড বোল্ড অভিষেক মুখোপাধ্যায়।