বিত্তশালী অংশ যখন 'টার্গেট অডিয়েন্স'

বিত্তশালী অংশ যখন 'টার্গেট অডিয়েন্স'

Sunday November 15, 2015,

7 min Read

Kae Capital এ আমরা যেসমস্ত ফার্মের সাথে কাজ করি ( আমার বিশ্বাস, অন্যান্য ঘরানার সংস্থার সাথে যেসব VC কাজ করে, এটা তাদের খত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য) তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে মাথায় রেখে তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গড়ে তুলেছে। এবং এই প্রবণতার একটি সঙ্গত কারণও অবশ্য রয়েছে। কারণ, এই শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণিই ভারতের একটি বড় ‘বাজার’ গড়ে তুলেছে, এবং সংখ্যাগতভাবে এই শ্রেণি ক্রমশই বাড়ছে। প্রমাণ চাইলে যেকোনো একটা সংবাদপত্র কিংবা কোনো কন্সাল্টিং ফার্মের সর্বশেষ অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট পড়ে দেখতে পারেন। কিংবা, এর বদলে বিকেলবেলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েও দেখতে পারেন। মার্ক অ্যানড্রিসেন যেভাবে করে, ঠিক সেভাবেই আমরাও বড় এক বাজারের উপস্থিতিকে বিনিয়োগের প্রাকশর্ত হিসাবে বিচার করি এবং ব্যাপক সংখ্যক ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তবেই বিনিয়োগ লাভজনক হয়।

সৌজন্যে - শাটারস্টক

সৌজন্যে - শাটারস্টক


কিন্তু বিগত বেশ কয়েক মাস যাবৎ লক্ষ্য করছি যে কমবেশি কিছুসংখ্যক ফার্ম এমন ধরনের পণ্য ও পরিষেবা বাজারে নিয়ে আসছে, যেগুলো বিশেষভাবে বিত্তশালী অংশকে মাথায় রেখে তৈরি। এটা নেহাতই কোনো আকস্মিক সংযোগ নাকি এর পিছনে অন্য কোনো গূঢ় কারণ রয়েছে, সেটা আগামী দিনই বলবে। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ওঁদের পরিকল্পনার উপযুক্ত বাজার এই মুহুর্তে রয়েছে কিনা, সেই বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইছিলেন। চড়া মূল্য রেখেও নিজেদের জন্য একটা বড় বাজার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, এরকম কোনো সংস্থার কথা উঠলেই অবশ্যম্ভাবীভাবে সবথেকে আগে আগে উঠে আসবে ‘অ্যাপল্‌’ সংস্থার নাম। সাধারণ প্রবণতাকে মান হিসাবে ধরে নিয়ে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার যে চলতি উপায় রয়েছে, আমি সেই পথে না হেঁটে বরং ঠিক করলাম যে, বিত্তশালী অংশকে মাথায় রেখে যেসব ব্যবসায়িক পরিকল্পনা অতীতে রুপায়িত হয়েছে, সেগুলির ইতিহাস ঘেঁটে আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে পৌঁছাবার চেষ্টা করব।

এবং আমি দেখলাম যুগান্তকারী বিবিধ উদ্ভাবনের মধ্যে বেশ কয়েকটা, যেগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্রেতাদেরকে আকর্ষণ করে এসেছে, সেগুলির শুরু হয়েছিল এমন দাম দিয়ে, যেটা কেনার সামর্থ্য ছিল কেবলমাত্র সমৃদ্ধিশালী অংশের মানুষদের।

১)অটোমোবাইল –

১১৮৫ খ্রীষ্টাব্দে কার্ল বেঞ্জই সর্বপ্রথম কমবাশন ইঞ্জিনচালিত গাড়ি তৈরি করলেন। এবং এই উদ্ভাবনের ফলে গাড়ি টানার জন্য আর ঘোড়ার প্রয়োজন রইলনা। খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ থেকে এই সময়পর্ব অবধি এটাই ছিল শহুরে সড়ক পরিবহণের সবথেকে জনপ্রিয় ব্যবস্থা।

এবং বিশ্বের প্রথন ইঞ্জিনচালিত গাড়ির আবিষ্কর্তা হওয়ার সুবাদে তিনি সম্পূর্ণ আনকোরা এক বাজারে নিজের পণ্যকে উপস্থিত করার সুযোগ পেলেন এবং এইভাবেই বেঞ্জ হয়ে উঠল বিশ শতকের গোড়ার সবথেকে বড় গাড়ি নির্মাতা সংস্থা। কিন্তু ঠিক কতটা বড় ছিল এই বাজার? একটা তথ্য দিলে সেটা বুঝতে সুবিধা হবে – বেঞ্জ ভিক্টোরিয়া, যা ছিল বেঞ্জ সংস্থার প্রথম পর্যায়ে নির্মাণ করা গাড়িগুলির মধ্যে একটি, সেটির বিক্রয়সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৫।


কিন্তু কেন?


আমার মতে, এর কারণ ছিল চড়া দাম । ১৮৯৩ তে এই গাড়ির দাম ছিল ৯০০০ গ্রেট ব্রিটেন পাউন্ড(আজকের দিনে যা ৫০,০০০ গ্রেট ব্রিটেন পাউন্ডের সমান। এতো দাম হবার কারণে উনিশ শতকের সবথেকে বিত্তবান কিছু মানুষের পক্ষেই কেবল এই গাড়ি কেনা সম্ভব ছিল। দামের ব্যাপারে বেঞ্জ এর কড়াকড়ির জন্যই এই সংস্থা যখন বেঞ্জ ভিক্টোরিয়ার অর্ধেক মূল্যে বিশ্বের প্রথম ‘সিরিজ প্রোডাকশান’ হিসাবে ‘বেঞ্জ ভেলো’ বাজারে আনল, তখন, ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ এর মধ্যে নতুন এই গাড়ির বিক্রয় সংখ্যা ছিল মাত্র ৫০০।

কিন্তু এই ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেল সুদৃশ্য এই গাড়িটির বাজারে আসার সাথে সাথেঃ


ফোর্ড টি মডেল

ফোর্ড টি মডেল


‘ফোর্ড মডেল টি ১৯০৮’ই সর্বপ্রথম গাড়িকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে এল। ১৯০৮ সালে যার বিক্রি শুরু হয়েছিল ৮৫০ ডলার মূল্যে, ১৯২৫ এ বিক্রয়মূল্য সেখান থেকে কমে হল ২৬০ ডলার। যুগান্তকারী উদ্ভাবন নিজেদের এই গাড়ির প্রচারে রাখা হেনরি ফোর্ডের বক্তব্য ছিল অনেকটা যেন ডন কর্লিওনে’র মত -

এই গাড়ির দাম এতোটাই কম হবে যে মোটামুটিভাবে ভালো উপার্জন করে, এরকম কোনো মানুষের পক্ষেই এই গাড়ি না কেনাটা সম্ভব হবেনা।

পরবর্তীতে ফোর্ড ছিলেন ‘অ্যাসেম্বলি লাইন’ এবং ‘ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম’ এর পথিকৃৎ, যা আজকের আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তিস্বরুপ হিসাবে গণ্য। এবং শিল্পোতপাদনে এই দুইয়ের অবদান অপরিসীম।


উচ্চবিত্ত মানুষের নাগাল ছেড়ে বেরিয়ে গাড়ি এখন সমাজের সমস্ত অর্থনৈতিক স্তরের কাছে একটি আবশ্যকতা হয়ে উঠল। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হেনরি ফোর্ড হয়ে উঠলেন বিশ্ব-ইতিহাসের অন্যতম বিত্তশালী ব্যক্তি।

দামী এই পণ্যকে বিত্তশালীর একচ্ছত্র দখল থেকে মুক্ত করার মধ্যে দিয়ে সকলেই লাভবান হলেন।

২) ইন্টারনেট –

বেঞ্জ থেকে ফোর্ড এবং তারপর টয়োটা থেকে ভোকস্‌ওয়াগেন এর বিবর্তনটা ঠিক কিরকম ছিল, সেটা দেখার জন্য আমি উপস্থিত না থাকলেও, ৯০’ এর দশকে ইন্টারনেট ব্যবস্থা কিরকম ছিল সেটা কিন্তু আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি।

১৯৯৮ সালে ভারতবর্ষে কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তখন সেটা বেশ চমকদার একটা ব্যাপার হত। বন্ধুদের দলে নিজেকে কেউকেটা প্রতিপন্ন করার জন্য ‘আমার হটমেল অ্যাকাউন্টে একটা ই-মেল পাঠাস তো’ বলাটাই যথেষ্ট ছিল। স্কুলের প্রজেক্টে সহযোগী তথ্য হিসাবে Alta Vista, Excite, Lycos প্রভৃতি সার্চ ইঞ্জিন থেকে পাওয়া ‘রেসাল্ট’ দেওয়া যেত, যেটা দেখে সবাই এমনভাবে আপনার দিকে তাকাত যেন আপনি কোনো টাইম-মেশিন থেকে বেরিয়েছেন। এছাড়াও বিবিধ জিনিস দেখা যেত ইন্টারনেটে।

৯০’ এর দশকে ইন্টারনেটে অভ্যস্ত হওয়া বিষয়টা তখন এতোটাই ঠাটের ছিল যে সেইসময় ‘হবি’ হিসাবে ‘ইন্টারনেট সার্ফিং’ যেকোনো ছেলে বা মেয়েকে নিসংশয়ে বুদ্ধিমান ও ‘টেক স্যাভি’র তকমা দিত!

কিন্তু সেইসময় ভারতে ইন্টারনেটের পরিধি এতোটা সীমাবদ্ধ ছিল কি কারণে? ১৯৯৫ সাল থেকে VSNL এর রেট চার্ট দেখলেই এর উত্তর পাওয়া যাবে -


image


ভারতে ইন্টারনেটের নবযুগের সূচনা –

১৯৯৫ সালে VSNL এর একটি ডায়াল আপ কানেকশানের মাধ্যমে ঘন্টা প্রতি ৬০ টাকা মূল্যে “এক বপছরে ২৫০ ঘন্টা অবধি” ৯.৬ কে বি পি এস কানেকশান ব্যবহার করা যেত। এর উপর ছিল ফোনের আলাদা চার্জ, কারণ ডায়াল আপ কানেকশান ব্যবহার করলে ফোনের লাইন এনগেজ হয়ে থাকত, যার ফলে অতিরিক্ত খরচের পাশাপাশি এইসময় কোনো ফোন এলে সেটা পাওয়া যেত না। আর ইন্টারনেট সার্ফ করার সময় আসা ফোন কোন নাম্বার থেকে আসছে, সেইসময়ের সাধারণ ‘ল্যান্ডলাইন’ এ সেটা জানার উপায় ছিলনা।

এবার চলে আসা যাক আজকের সময়ে – এটা আজ সাধারণভাবে সবাই জানে যে ব্রডব্যান্ড, থ্রিজি ও ফোর জি হল পিরামিডের ভিতকে মজবুত করার সবথেকে ভালো উপায়।

২০ বছরের মধ্যে একটা ব্যায়বহুল ‘শখ’ থেকে ইন্টারনেট হয়ে উঠেছে অর্থনীতিতে মানুষের সংযুক্তিকরণের সবথেকে বড় উপকরণ।


৩) সেলফোন


image


দুনিয়ার সর্বপ্রথম ফ্লিপ ফোন – দ্যা মোটোরলয়া স্টারট্যাক

ইন্টারনেটের থেকেও স্বল্প পরিধিতে ব্যাপ্ত(সেই সময়ে) আরো একটি প্রযুক্তিকে ফিরে দেখার জন্য আবারও একবার পিছিয়ে যাওয়া যাক ৯০’এর দশকে। হ্যাঁ, আমি সেলফনের কথা বলছি।

দুনিয়ার প্রথম ফ্লিপ ফোন - মোটোরলা স্টারট্যাকের দাম ১৯৯৬ সালে ছিল ১০০০ মার্কিন ডলার।

১৯৮০ থেকে সেলফোনের দাম কিভাবে বদলেছে, সেটা একবার খেয়াল করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন যে ‘launch price’ ১০০০ মার্কিন ডলার রাখাটাই সেইসময়ের চল ছিল। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমরা তখন আমাদের পুরানো ল্যান্ডলাইন ব্যবহারের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম।

কিন্তু শুধু দামের কথা বললে সেলফোনের ইতিহাসের অর্ধেকটাই অজানা থেকে যাবে।

কেন ভারতের মানুষ সেলফোন নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, নিচের চার্টটা দেখলেই সেটা বুঝতে পারবেন -


image


নিজেকে একবার ৯০’ এর দশকের কোনো সেলফোনের গ্রাহক হিসাবে কল্পনা করুন। ‘অত্যাধুনিক’ মোবাইল ফোন কেনার জন্য আপনাকে একটা বড় পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়েছে তাই-ই শুধু নয়, বরং আউটগোয়িং কল এর জন্য আপনাকে প্রতি মিনিটে ১৬ টাকা এবং ইনকামিং এর জন্য প্রতি মিনিটে ছয় টাকা করে দিতে হচ্ছে।

সে-সময় খরচ এতোটাই বেশি ছিল যে সাধারণ মানুষের পক্ষে মোবাইল ফোন কেনা বা ব্যবহার করা সম্ভব ছিলনা। বা ব্যবহার করলেও শুধুমাত্র মিস্‌ড কল দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হত।

অত্যাধিক দাম এবং চড়া কলরেটে ব্যবহারের জিনিস এই মোবাইল ফোন কিভাবে আজকের দিনে দেশের ৭৮ শতাংশ মানুষের ব্যবহারের আওতায় চলে আসল, সে আখ্যান কোনো অংশে রুপকথার চেয়ে কম নয়।


৪) আর এই তিনটে যখন একসাথে চলে এল –

এরকম কোনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনার কথা ভাবতে পারেন যা অটোমোবাইল, ইন্টারনেট ও সেলফোন – এই তিনের ব্যবহারিক ক্ষমতাকে একজায়গায় নিয়ে এসেছে?

‘উবার’(কিংবা ওলা, লিফট, কুয়াইডি বা গ্র্যাবট্যাক্সি) – এই উত্তর দিয়ে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে আপনার বোধহয় একমুহুর্তও সময় লাগেনি।

উবার অনেকগুলি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে সেটা যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই কিন্তু এটাও ঠিক যে উবার-উত্তর অর্থনীতির কাছে আমরা নানাভাবে কৃতজ্ঞও বটে। উবারের সবথেকে বড় সাফল্য বোধহয় এটাই যে এই সংস্থা ‘পেশাদার গাড়িচালক’ এর মত একটি ‘ব্লু-কলার প্রফেশান’কে শহুরে মধ্যবিত্ত ঘরানার পেশাগুলির মধ্যে স্থান করে দিতে পেরেছে( হ্যাঁ, অন্যান্য সংস্থাগুলির মত উবারের টার্গেট গ্রুপ’ও কিন্তু সেই একই শ্রেণি)।

অতয়েব দেখা যাচ্ছে যে অন্যতম একটি ‘পাবলিকলি লিস্টেড ফার্ম’ এবং অন্যতম একটি ‘প্রাইভেট ফার্ম’ – উভয়ের সাফল্যের কারণ হিসাবে থেকেছে একটি সঠিক মূল্য নির্ধারণ নীতি এবং এমন উদ্ভাবন, যা প্রাথমিকভাবে তৈরি হয়েছিল বিত্তশালী অংশকে মাথায় রেখে। এটা কি নিছকই আকস্মিক সংযোগ, নাকি একটা গ্রহণযোগ্য নকশা দেখা যাচ্ছে এর মধ্যে দিয়ে?



(নিবন্ধে ব্যক্ত মতামত একান্তভাবেই লেখকের ব্যক্তিগত। এবং এর সাথে ইয়োরস্টোরি’র কোনো সমন্ধ নেই।)

লেখক পরিচিতি – শুভঙ্কর ভট্টাচার্য একটি ‘আর্লি স্টেজ VC FUND’ , ‘Kae Capital’ এর ভেঞ্চার পার্টনার। Kae এর সাথে যুক্ত হওয়ার পূর্বে তিনি ছিলেন হীরে ও হীড়ের গয়না বিক্রয়ের একটি অনলাইন ষ্টোর Yaqsh.com এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও CEO। CMS info system এবং Technip এ তিনি একাধিক গুরুতপূর্ণ দায়িত্ব সামলেছেন। শুভঙ্কর NIT Trichy র স্নাতক এবং তারপর MBA করেছেন ISB, Hyderabad থেকে। শুভঙ্করের সাথে LinkedIn মারফত যোগাযোগ করতে পারেন।