“স্কুল পাঠ্য ইতিহাসের বাইরে আমাদের আশেপাশে ‘জিগস পাজল’ এর মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টুকরো টুকরো ইতিহাস। আর আমি আমার অঙ্কপ্রেমী লজিকাল মন দিয়ে সেইসব ছড়ানো টুকরোগুলোকে জুড়ে জুড়ে আমার ব্লগে একটা অন্যরকম ইতিহাস চেতনা তৈরি করতে চাইছি”।
আর আমরা সেই অন্যরকম ইতিহাসেরই সন্ধান পাই রঙ্গন দত্তর ব্লগ থেকে। কলকাতার চীনে পাড়ার জন্ম থেকে ভিস্তিওয়ালাদের কথা, কলকাতায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের স্মারক থেকে মহিষাদলের রথযাত্রা, হুগলীতে সেন্ট জন এর সোনার হাত থেকে গ্রাস্টিন প্লেসের পুরনো ভূত – কি নেই তাঁর গল্পের ঝুলিতে!
পেশায় টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের কলেজে গণিতের শিক্ষক। নেশায় একজন ভ্রামণিক ও হেরিটেজ ব্লগার। কলকাতা ও তার আশেপাশের ঐতিহাসিক স্থানের নাম দিয়ে গুগল সার্চ করলে সার্চ রেজাল্টে এক থেকে দশের মধ্যে তাঁর ব্লগটি আসবেই।
সেইসব অজস্র পরিচিত, অপরিচিত বা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহাসিক স্থান কাল পাত্রদের না শোনা গপ্পোকথা পড়তে পড়তে আপনি বোর তো হবেনই না, বরং ইচ্ছে করবে এক ছুটে সেইসব জায়গায় চলে যাই। ঘুরে আসি দু-দিন।
কিন্তু এই ক্যালকুলাস আর ইন্টিগ্রেশানের খটমট রাজপথ থেকে ইতিহাসের ছায়াচ্ছন্ন গলিটিকে আবিষ্কার করলেন কিভাবে? এক গাল হেসে রঙ্গন বললেন, “সত্যি কথা বলতে স্কুলে আমার ইতিহাসের থেকে প্রিয় সাবজেক্ট ছিল ভূগোল। আর সেই সূত্রে আমারও প্রাথমিক বেড়ানোর হাতেখড়িটা ছিল মূলত অ্যাডভেঞ্চার মূলক ঘোরাঘুরি। ট্রেকিং, রক ক্লাইম্বিং, ব়্যাফটিং , স্কিইং ইত্যাদি। আর সঙ্গে ছবি তোলা”। আর এই ট্রেকিং নিয়েই ২০০০ সাল থেকে তিনি খবরের কাগজে লেখালিখি শুরু করেন। এইভাবেই সিকিমের পাহাড়ে ট্রেকিং-এ গিয়ে প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির দেখে তাঁর আগ্রহ জন্মায় বাঙলার মন্দির শিল্পে। দা টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে বাঙলার অজস্র ঐতিহ্যশালী টেরাকোটা মন্দিরগুলি নিয়ে তথ্যমূলক প্রবন্ধাবলী লেখার শুরুও তখনই। কিন্তু খবরের কাগজের নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ ও স্থান সংকুলানের অভাবে রঙ্গনের অভিজ্ঞতায় অজস্র গল্প জমে ছিল। দরকার ছিল সেগুলোকে প্রকাশ করার একটা প্ল্যাটফর্ম। সেই কারণেই ২০১১ সালের জুন মাসে তিনি শুরু করলেন তাঁর নিজের ব্লগ।
ব্লগটিতে বর্তমানে রয়েছে ২২৫ টি মূল্যবান গবেষণা ধর্মী পোস্ট এবং প্রতিদিন তা একটু একটু করে বেড়েই চলেছে। ব্লগের পোষ্টগুলির মধ্যে হালকা চালের বেড়ানোর মধ্যেই উঁকি ঝুঁকি মারে ইতিহাস আর বিস্মৃত ঐতিহ্যের কথা।
আর এই সব গল্পের লোভেই তাঁর ব্লগে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ থেকে ছ’শ জন ভিসিটর হানা দেন। এখনও পর্যন্ত চার লক্ষের বেশী মানুষ এই ব্লগ পড়েছেন আর ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার নিয়মিত ফলোয়ার। ইন্ডিব্লগার নামক সংস্থার বিচারে রঙ্গনের ব্লগটি সারা দেশের কোটি কোটি ব্লগের মধ্যে ৮১ তম স্থান পেয়েছে। আর ‘হলিডেফি’ এর বিচারে রঙ্গনের ব্লগ প্রথম দশটি বেড়ানো সংক্রান্ত ব্লগের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। আর কেবল দেশীয় সংস্থাই নয়, অজস্র বিদেশী সংস্থাও এগিয়ে এসেছে রঙ্গনের কাজে উৎসাহ দিতে। যাদের মধ্যে একটি প্রধান নাম ইন্টারনেট দুনিয়ার মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডার উইকিপিডিয়া।
রঙ্গনের মত মানুষদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও প্রান্তিক কমিউনিটিতে হয়ে চলেছে উইকিপিডিয়ার মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডারে কন্ট্রিবিউট করার ওয়ার্কশপ, সেমিনার এবং স্থানীয় ইতিহাস চর্চার ‘হেরিটেজ ওয়াক’ ও ‘ফটোগ্রাফি ওয়াক’। আনকোরা চোখ ও অ্যামেচার ক্যামেরার লেন্স খুঁজে নিচ্চে নিজস্ব শিকড়ের সেপিয়া ল্যান্ডস্কেপ।
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নতুন যুবসমাজের মধ্যে তৈরি হচ্ছে নিজস্ব হেরিটেজের প্রতি অ্যাওয়ারনেস। আর এইসব মানুষদেরকে রঙ্গন শেখাচ্ছেন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে সুখপাঠ্য করে লিখে নিজের ব্লগে প্রকাশ করার ও জনপ্রিয় করার হরেক কায়দা। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, "সার্চ ইঞ্জিনে কোন সাইটের তথ্য আগে আসবে তার জন্য গুগল একটা অ্যালগোরিদম ফলো করে থাকে। আর এক্ষেত্রে আমার অঙ্কের মাথা আমাকে বেশ অনেকটাই সাহায্য করে। আমার ব্লগের লেখায় নির্দিষ্ট কীওয়ার্ড সিলেকসান, তার ডেনসিটি ও ডিস্ট্রিবিশান ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর পিছনে আমি প্রচুর সময় ও লজিক ব্যয় করি"।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যটন দপ্তর সহ অন্যান্য নানা দেশের পর্যটন দপ্তর আপ্যায়ন করে নিয়ে গেছে রঙ্গনকে, হেরিটেজ অ্যাওয়ারনেসের জন্য কি পদক্ষেপ নেওয়া যায় তাই নিয়ে আলোচনার জন্য। গত বছরেই বাংলাদেশের ঢাকায় অনুষ্ঠিত উইকিপিডিয়ার দশম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বিশেষ সম্মানে ভূষিত হয়ে এলেন তিনি। দেশ বিদেশের বহু ঐতিহ্যশালী বাড়িকে হেরিটেজ হোটেলে পরিণত করার ক্ষেত্রেও মূল্যবান অবদান রেখেছেন তিনি। কিন্তু এতোসব কিছুর পরেও পশ্চিমবঙ্গের হেরিটেজ ট্যুরিজমের পরিস্থিতি নিয়ে রঙ্গনকে খুব একটা আশাবাদী শোনালো না। “আমার চোখের সামনে আমারই শহরে ও গ্রামে একের পর এক হেরিটেজ বিল্ডিংকে ভ্যানিশ হয়ে যেতে দেখেছি। রিয়েল এস্টেটের ভ্যালু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত প্রাচীন স্থাপত্যগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে, আর সেগুলোকে বাঁচানোর ব্যাপারে রাজ্য সরকারেরও খুব একটা সদর্থক ভূমিকা চোখে পড়েনা”, হতাশার সুর রঙ্গনের গলায়।
কিন্তু সে জন্য হতাশাগ্রস্থ না হয়ে বরং নতুন উদ্যমে একের পর এক কাজ করে চলেছেন রঙ্গন। নিজের ইংরাজি ব্লগটিকে নতুন করে সাজানোর পাশাপাশি তাঁর ব্লগের একটি বাংলা ভার্সানও লঞ্চ করতে চান তিনি। আর নিজস্ব ব্লগ লেখার পাশাপাশি কমিউনিটির সমস্ত মানুষকে নিয়ে হেরিটেজের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে খুব শীগগিরই উইকিপিডিয়ার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আগামী তিন মাসের মধ্যেই তিনি আনতে চলেছেন হেরিটেজ সংক্রান্ত বাংলা সাইট ‘উইকিভ্রমণ’। ‘উইকিভয়েজ’ এর ঢঙে এই বাংলা ওয়েবসাইটে যে কেউ বিশ্বব্যাপী অন্তর্জ্বালের মুক্ত জ্ঞানভাণ্ডারে তার নিজস্ব ইতিহাস-ভ্রমণ মূলক প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারেন। রঙ্গনের কথায়, “এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা সহ হেরিটেজ ট্যুরিজম এর নানা দিকগুলি একটা ব্যাপক বুস্ট পাবে। আমি আশাবাদী যে কমিউনিটির সমস্ত স্তরের মানুষ একত্রে হাত মিলিয়ে এবং সরকারের সহযোগিতায় আমরা আমাদের ঐতিহ্যের শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো”।