ই-শপিংয়ের মরসুমে কতটা তৈরি ফ্লিপকার্ট-অ্যামাজন
সেল – সেল – সেল। কলকাতার হাতিবাগান বা গড়িয়াহাট নয়, সেলের এই হাঁকডাক আসছে ইন্টারনেট আর মোবাইল অ্যাপ থেকে। বিগ বিলিয়ন ডে’জ, গ্রেট ইন্ডিয়ান ফেস্টিভ সেল – বাহারি নামে লাখও পসরা সাজিয়ে দিল কি ডিল নিয়ে হাজির দেশি বিদেশি ই-কমার্স সংস্থাগুলি। সকালের খবরের কাগজ থেকে ইন্টারনেটের পাতা, এমনকি মোবাইলের ইনবক্স, সবটা জুড়েই সস্তায় কেনাকাটার হাতছানি। উৎসবের মরসুমে সস্তার কেনাকাটার এই লোভ সংবরণ করা বড়ই কঠিন। তাই ই-শপিংয়ে সিদ্ধহস্ত কলেজ পুড়ুয়া অর্চি তার গার্লফ্রেন্ডের জন্য একটা দামী ইয়ারফোন অর্ডার দিয়েছে। আবার ইন্টারনেটে অনভ্যস্ত শ্যামল কাকুও প্রথ্ম স্মার্টফোনটা অর্ডার দিয়েছেন অনলাইনেই। কিন্ত দু’জনের মনেই আশঙ্কা - সেই সাধের জিনিস অক্ষত অবস্থায় ঠিক সময়ে হাতে এসে পৌঁছবে তো!
সারা বছর যেভাবে ফোনের বদলে পাথরের টুকরো কিংবা দেরি করে অর্ডার ডেলিভারির অভিযোগ কানে আসে, তাতে আশঙ্কার এই মেঘ কমবেশি সমস্ত ই-শপারের মনেই দানা বাঁধে। তারওপর গত বছর এরমকমই এক সেলের সময় অত্যুৎসাহী ক্রেতাদের চাপে এক সংস্থার ওয়েবসাইটই থমকে গিয়েছিল। তাই সংস্থাগুলির কাছেও সফলভাবে এই সেল সমারোহ উতরে দেওয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
ফ্লিপকার্ট, অ্যামাজন, স্ন্যাপডিল – বাজারে অংশীদারিত্বের নিরিখে সর্ববৃহৎ এই তিন ই-কমার্স সংস্থার দাবি ই-শপিংয়ের সিংহভাগই হয় মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে। ফ্লিপকার্ট ও স্ন্যাপডিলের হিসেব বলছে সেই সংখ্যাটা মোট বিক্রির ৭৫%।
ফেস্টিভ সিজনে বিক্রিবাটা পরিচালনা করতে তিনটি সংস্থারই আলাদা আলাদা স্ট্র্যাটেজি। স্ন্যাপডিল ও অ্যামাজনের অফারগুলো মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট উভয়েই পাওয়া গেলেও ফ্লিপকার্ট আবার শুধুমাত্র মোবাইল অ্যাপেই সেলের কেনাকাটার সুযোগ দিয়েছে। স্ন্যাপডিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল তনেজা জানিয়েছেন, দীপাবলি পর্যন্ত কেনাকাটাতে নানারকম অফার দেবে তাঁর সংস্থা। কিন্তু ফ্লিপকার্ট আর অ্যামাজন আবার সমানে সমানে ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত এই সেল উৎসব চালিয়েছে।
অ্যামাজনের ক্যাটেগরি ম্যানেজমেন্ট শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট সমীর কুমারের আশা চলতি বছরে মোবাইল অ্যাপে বিক্রিবাটা ১০% বাড়বে। দোকান বাজারের ক্ষেত্রে উৎসবের মরসুমের পর বিক্রিবাটায় কিছুটা ভাটার টান আসে। কিন্তু স্ন্যাপডিল কর্তা রাহুল তনেজা দাবি, ক্রেতার সংখ্যা কমে তো নাই বরং দীপাবলির পর আরও বেশি ক্রেতার আগমনটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। একটি সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, মাত্র ৫ বছরে ভারতে ই-কেনাকাটার বাজার বেড়েছে ১ কোটি ৬০ লক্ষ মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে যেখান ৫৩ লাখ মার্কিন ডলারের বিক্রবাটা হয়েছিল, সেখানে চলতি বছরে এখনই সেই সংখ্যাটা ২ কোটি ৪০ লক্ষ মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে। অর্থাৎ অর্ধ দশকেই বৃদ্ধির পরিমাণ ৩০৩.৭৭%। শুধু ই-কমার্স সংস্থাগুলোই নয়, পেটিএম, ফ্রিচার্জের মতো অধুনা জনপ্রিয় হওয়া ই-ওয়ালেট সংস্থাগুলিও এই উৎসবের মরসুমে ভাল ব্যবসার আশা করছে। ক্যাশ কারো বলে সংস্থাটি অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসার আশা করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের এই সেল সিজনই বলে দেবে বাজার ধরার ক্ষেত্রে কোন ই-কর্মাস সংস্থা কতটা এগিয়ে। বাজার ধরার এই যুদ্ধে কেউ কারওকে এক চুল জমি ছাড়তে রাজি নয়। সেই কারণেই আরও বেশি করে এই সেলের রমরমা। একটা সেল উৎসব তৈরি করে ক্রেতাকে বাজারমুখি করে তোলা।
ই-ক্রেতাদের নিয়ে www.yourstory.com এর করা একটি সমীক্ষা অনুযায়ী বর্তমানে বাজারের ৩৭.৬% ফ্লিপকার্টের দখলে, বাজারের ২৯.৫%-এর দখল নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অ্যামাজন। স্ন্যাপডিল তৃতীয় স্থানে থাকলেও তাদের দখলে বাজারের মাত্র ৭%।
ফ্লিপকার্ট এবং স্ন্যাপডিলের দাবি, গত বছর একদিনের সেল থেকে তাদের ৬০০ কোটি টাকার বিক্রিবাটা হয়েছিল। তবে সেবার ক্রেতাদের চাপে ওয়েবসাইটগুলির নাকাননিচোবানি খাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। ঠিক সময় ওয়েবসাইট খুলেও কেনাকাটা না করতে পেরে হতাশ হয়েছিলেন অনেক ক্রেতাই। সংস্থাগুলি অব্শ্য গতবারের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
তথ্যভাণ্ডার বা ডেটা সেন্টারের সংখ্যা বাড়িয়ে ফ্লিপকার্ট তাদের ওয়েবসাইটের ক্ষমতা গত ৬ মাসে ৩ গুণ বাড়িয়েছে। ক্রেতাদের অভাব-অভিযোগ শোনার জন্য কল সেন্টারের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর যে সেল উৎসব অনুষ্ঠিত হল, তাতে এক একটি দিন এক এক ধরণের সামগ্রীর সেলের জন্য ধার্য করা হয়েছিল। ওয়েবসাইটের ওপর চাপ কমানোর এই কৌশলকেও বিশেষজ্ঞরা সাধুবাদ জানিয়েছেন।
বিগত এক বছর ধরে একাধিকবার সেল চালিয়ে স্ন্যাপডিল তাদের ওয়েবসাইটের ক্ষমতা পরখ করেছে। এই সময়টায় নিজেদের ভুল-ত্রুটিও শুধরে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে সংস্থাটি। উৎসবের মরসুমে যাতে সংস্থার সঙ্গে জড়িত বিক্রতাদের পুঁজিতে টান না পড়ে, তার জন্য ক্যাপিটাল অ্যসিস্ট প্ল্যাটফর্ম চালু করেছে স্ন্যাপডিল। শুধু তো আর যোগান ঠিকঠাক থাকলেই হল না, ই-কর্মাসের সাফল্যের অণ্যতম শর্ত উন্নত লজিস্টিক্স বা মসৃণ সরবরাহ পরিকাঠামো। স্ন্যাপডিলের হয়ে কাজ করে গো জাভাস নামে একটি লজিস্টিক্স সংস্থা। ওই লজিস্টিক্স সংস্থার পরিকাঠামো উন্নয়নে গত ৬ মাসে তারা ১০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছে। এর মধ্যে অক্টোবরেই গো জাভাসে ২ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে স্ন্যাপডিল।
অ্যামাজনও তাদের পরিকাঠামো ঢেলে সাজিয়েছে। লাস্ট মাইল নামক লজিস্টিক্স সংস্থার পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়েআগের পাশাপাশি তারা ৮টি নতুন ফুলফিলমেন্ট সেন্টার বা গুদাম তৈরি করেছে। বর্তমানে দেশের ১০টি রাজ্যে অ্যামাজনের ২১টি ফুলফিলমেন্ট সেন্টার রয়েছে - যার সম্মিলিত আয়তন ২০ লক্ষ বর্গ ফিট।
এত পরিসংখ্যান থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট – পরিষেবা ত্রুটিহীন রাখতে কসুর করছে না সংস্থাগুলি। লক্ষ কোটি টাকার এই রণকৌশল কতটা কার্যকর হয় তার উত্তর পেতে গেলে আপনাকেও অনলাইন সেলের জোয়ারে গা ভাসাতেই হবে।