মনের মতো গল্প শোনায় Jabbercast

মনের মতো গল্প শোনায় Jabbercast

Saturday December 19, 2015,

6 min Read

গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে, শুধু গল্পের বিষয়গুলো বদলে যায় সময় আর বয়সের সাথে সাথে। বদলে যায় গল্পের বিষয়বস্তু। রেডিওতে ভালো ভালো গল্প শোনার সুযোগ থাকলেও অনেক সময়ই বাঁধা হয় সময়, এই সমস্যার সমাধান করতেই একটা নতুন আইডিয়া জন্ম নিয়েছিল এক দশক আগে - পডকাস্টিং। আর এই আইডিয়া কে নিয়েই শুরু হয় কিছু নতুন শুরুয়াতি ব্যবসা, সেরকম একটা স্টার্ট-আপ হল Jabbercast, যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রোহণ খাঁরা বলছিলেন যে ২০১০ অবধি এই বিষয়ে কোন ধারণাই ছিলনা ওনার, কিন্তু আজকে তিনি ভারতের একটা অন্যতম স্টার্ট-আপকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাদের মুল উদ্দেশ্য গল্পকার আর গল্প শোনার মানুষগুলোর মধ্যে একটা সুন্দর যোগাযোগ তৈরি করে দেওয়া। উনি বলছিলেন যে অনলাইনে ভিডিও দেখার কিংবা গান শোনার সুযোগ থাকলেও, গল্প শোনার মতো কোন অপশন সেভাবে তখনো ছিলনা কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন এর চাহিদা আছে প্রচুর আর এখানেই তিনি একটা যোগসূত্র তৈরি করতে চেয়েছেন তার এই শুরুয়াতি ব্যবসার মাধ্যমে।

বাঁদিক থেকে - গুস্তাভ, রোহণ এবং বিজয়

বাঁদিক থেকে - গুস্তাভ, রোহণ এবং বিজয়


ইওর স্টোরির সাথে কথা বলার সময় তিনি বলছিলেন কিভাবে এই আইডিয়াটা মাথায় এলো তাঁর। হঠাত করেই একদিন এই পডকাস্টিং ইন্ডাস্ট্রির বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দিয়ে তিনি তাঁর এক বন্ধুর থেকে একটা ইমেল পায়। সাথে সাথে বিষয়টা নিয়ে একটা রিসার্চ করতে শুরু করে দেন তিনি। বিভিন্ন অ্যাপ্ নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেন বিষয়টাকে আত্মস্থ করার জন্য, প্রায় ছয় সপ্তাহের বেশি সময় লেগেছিল তার পুরো বিষয়টা বুঝে উঠতে। আস্তে আস্তে সে বুঝতে পারে তার বন্ধু গুস্তাভ যে সুবিধা অসুবিধার কথাগুলো তাকে জানিয়েছিল, সেগুলো কতোটা সত্যি, আর সেখান থেকেই জন্ম নেয় Jabbercast. তিনি বলছিলেন যে পডকাস্টিং এর জনপ্রিয়তা প্রতিদিনই বাড়ছে। শুধু শ্রোতার বিচারে নয়, কোন একটা এপিসোডে অ্যাড কিরকম হচ্ছে সেটাও বিচার্য বিষয়। এই অডিও প্রোগ্রামিং থেকে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার এসেছে শেষ বছর। তাই তিনি মনে করেন যে তাঁদের জন্য এটাই একদম সঠিক সময় এই ইন্ডাস্ট্রিতে আরও বেশি করে বিনিয়োগ করার।

পরিষেবার ফলাফল পরিসংখ্যান

রোহণ আমাদের বলছিলেন যে প্রায় ৪৬ মিলিয়ন আমেরিকান প্রতিদিন এইধরনের অডিও প্রোগ্রাম শোনেন আর এই সংখ্যাটা প্রায় ১৫-২৫% হারে বেড়ে চলেছে প্রতি বছর। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে এরা সবাই প্রতিদিন প্রায় দুঘণ্টা করে ব্যয় করেন এর জন্য, যেটা বেশ আকর্ষণীয় একটা সংখ্যা। ২০১৪ সালে সংখ্যাটা ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ঘণ্টা আর তার মতে এটা ২০১৬ তে প্রায় ১০ বিলিয়ন ছুঁয়ে ফেলবে। এই পরিসংখ্যান থেকেই সাফল্যের পথ খুঁজছেন রোহণ বাবু। আসলে Jabbercast অন্য সবার থেকে আলাদা কারণ তারা কিছুটা ভ্যালু অ্যাড করেছে এই পরিষেবাতে। এতদিন যে অ্যাপ্লিকেশান গুলো ছিল সেখানে কোন অডিও ফাইল শেয়ার করার অপশন ছিল কম কিন্তু শ্রোতা তার পছন্দের অডিওটা তার বন্ধুকে বা প্রিয়জনকে শেয়ার করতে চাইলে তা সম্ভব হতনা। Jabbercast সেই দরজাটাই খুলে দিয়েছে। নিজের পছন্দ মতো পডকাস্ট খোঁজার আর তা শেয়ার করার জন্য একটা আলাদা অপশন রেখেছে তারা, অনেকটা কাস্টমাইজড করেছে এই পরিষেবাকে গ্রাহকের সুবিধার জন্য। আসলে সুস্বাদু খাবার অনেকেই বানাতে পারে কিন্তু সেটাকে কিভাবে আপনি পরিবেশন করবেন সেটার ওপরেও নির্ভর করে ব্যবসায়িক সাফল্য। আসলে ফেসবুক বা ফ্লিপবোর্ডের মতো প্ল্যাটফর্ম গুলতে যেমন বিভিন্ন কনটেন্ট শেয়ার করার জায়গা আছে, পুরনো পডকাস্ট অ্যাপ্লিকেশন গুলোতে সেই সুবিধা ছিল না। এখানেই নতুনত্ব এনেছেন এঁরা। রোহণের লক্ষ্য পডকাস্টিং দুনিয়ায় ফ্লিপবোর্ডের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করা।

image


'যে বিশেষত্ব আমাদের অন্য সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে তা হল একটা দর্শনীয় স্লাইড শোয়ের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটাকে শ্রোতা তার অডিও স্ক্রিনে দেখতে পায় jabbercast এর মাধ্যমে। এছাড়া যে বিষয়ে আপনি শুনছেন, সেটা নিয়ে বিশদে জানতে চাইলে একটা ক্লিকেই আপনি সে বিষয়ের যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। এছাড়াও একই অ্যাপ্লিকেশনের মধ্যে থেকে আপনি চাইলে ট্যুইটারের মাধ্যমে আপনার পছন্দের মানুষের সাথে কথাও বলতে পারেন।'

সাফল্যের পথটা বেশ দীর্ঘ ছিল রোহণের। কলকাতার ছেলে রোহণ ব্যাঙ্গালোর থেকে পড়াশুনার পাঠ শেষ করে চাকরিজীবন শুরু করে। মাইক্রোসফট, কুইকারের মতো কোম্পানিতে বেশ কিছুদিন কাজ করে দিল্লী, মুম্বাই করার পর তার মনে হয় নিজে কিছু করাটা দরকার। মনটা যেন নিশপিশ করছিল। সাথে ভারতে স্টার্ট আপের বাড়বাড়ন্ত তাকে বারবার খোঁচা দিচ্ছিল কিছু করার জন্য। কিন্তু খুব কম লোক পডকাস্টে ফুলটাইম কাজ করছিল সে সময়। সবারই এটা একটা এক্সট্রা ইনকামের জায়গা। আসলে সময়টা ছিল পডকাস্টের প্রথমদিক। তখন দরকার ছিল আরও সচেতনতা, আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছানোটা দরকার ছিল বিষয়টা নিয়ে। আরও ভালো শো, ভালো এপিসোড আর অডিওমেটিকের মতো ভালো নেটওয়ার্ক থাকলে যে এখান থেকেই উন্নতি সম্ভব সেটা বুঝতে পেরেছিল রোহণ। কিন্তু ২০১৫ সালে এই আন্ত্রেপ্রেনারশিপ ব্যাপারটা যতটা সফলতার সাথে চলছে, কিছুদিন আগেও ছবিটা এতোটা রঙিন ছিলনা। ২০১০ সালে যখন কাজটা করার কথা প্রথম ভাবে সে, তখন অনেকেই বিষয়টা জানত না। এখন যেমন অনেকে দু-তিন বছর চাকরি করে কিংবা প্রথম থেকেই নিজের ব্যবসা করার কথা ভাবতে পারছে, বা চাকরি করার পরেও বাকি সময়টাকে কিভাবে ব্যবহার করা যায় সেসব নিয়ে ভাবছে, সেটা ওই সময় ছিলনা। রোহণের মতে এখন সবাই যে এই অল্প বয়স থেকেই ব্যবসা করার কথা ভাবছে, তার একটা ভালো দিক হল প্রথম দিকের ভুলগুলো থেকে এরা ভবিষ্যতের ভিতটা মজবুত করতে পারছে। সাথে অভিজ্ঞতাও বাড়ছে, যা তাদের ভবিষ্যতে সফলভাবে ব্যবসা করতে সাহায্য করবে। সাথে নতুন প্রজন্ম অনেক নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসছে এই কাজে, ফলে যোগদান যেমন বাড়ছে, সাথে অর্থনৈতিক সাফল্যও আসছে। ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে একটা সুসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা একটা পজিটিভ ইঙ্গিত দিচ্ছে।

সহ কর্মীর সাথে রোহণ খাঁরা

সহ কর্মীর সাথে রোহণ খাঁরা


ভিশন অ্যান্ড মিশন স্টেটমেন্ট

রোহণ আর তার দুই বন্ধু গুস্তাভ বিটনাগর, বিজয় রাঘবন মিলে জন্ম দিয়েছিলেন এই অডিও প্রোগ্রামিং সিস্টেমের। কলেজে পড়ার সময় প্রথম পরিচয় হয় তিনজনের, তারপর থেকে বন্ধুত্বের ভিতটা মজবুত হতে থাকে। নিজেদের মত, ভাবনাচিন্তা সবই শেয়ার করত তারা একে অপরের সাথে। আর এই মিলিত প্রচেষ্টাতেই জন্ম নেয় Jabbercast. প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকার লড়াইটাই আসলে প্রধান ছিল। অন্যান্য ব্যবসার মতো মার্কেটিং এ জোর না দিয়ে ওদের লক্ষ্য শ্রোতার চাহিদা উপলব্ধি করা, পরিসেবার মান উন্নত করা। কিছুদিন আগেই তারা সানফ্রানসিসকোর অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের সাথেও আলোচনা করেছে বিনিয়োগের বিষয় নিয়ে আর ফলাফলও বেশ আশাব্যঞ্জক। রোহণের মতে প্রতিযোগিতার বাজারে শুরুয়াতি ব্যবসার মজাটা শুরু হয় কিছুদিন পর থেকে যখন ব্যবসার ওঠানামাটা একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। চলার পথে অনেক ভুল পদক্ষেপ গতিকে রুদ্ধ করে দিতে পারে, আশেপাশের অনেকের কিছু মন্তব্য ভোঁতা করে দেয় কনফিডেন্স। সাথে অর্থনৈতিক ওঠাপড়া তো লেগেই আছে, কিন্তু ধৈর্য ধরে শক্ত হাতে নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারলে সাফল্য আসতে বাধ্য। সময় একটু বেশি লাগলেও মজবুত হয় পায়ের তলার ভিত। আসতে আসতে যখন বাজারের সবথেকে ভালো ব্র্যান্ডের সাথে নিজের প্রোডাক্টের তুলনা হতে শুরু করে, আপনার প্রোডাক্ট নিয়ে যখন আপনার সামনেই কোন ক্রেতা প্রশংসা করে তখন যেন একটা আলাদা রকম আনন্দ পাওয়া যায়, আর এখানেই আসল সফলতা।

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

রোহণ মনে করেন অডিও মাধ্যমে গল্প বলা আর শোনার মধ্যে যে অসীম একটা রুপান্তরকামী শক্তি আছে, সেটাতেই বিশ্বাস করেন তারা। আসলে অডিও মাধ্যমের একটা নিজস্বতা আছে, যা ভিডিও বা অন্য কোন মাধ্যমে সেভাবে পাওয়া যায়না। সেইকারণেই পডকাস্টিংকে মূলস্রোতে আনাটা জরুরী। আর তাদের বিশ্বাস Jabbercast নিশ্চয় সেই কাজটা সাফল্যের সাথেই করতে পারবে। রেডিওতে চ্যানেল ঘোরানোর মতই সহজলভ্য করে তোলা দরকার এটা। বলছিলেন 'একবার কল্পনা করুন তো, আপনার গাড়িতে বসে, কাজের জায়গায় বা ট্রেন, বাসে বসে আপনার ফোনের একটা ক্লিকেই আপনি শুনতে পাবেন বিশ্বের নামীদামী মানুষের গল্প। আমরা চাই আরও বেশি করে মানুষ Jabbercast এর মাধ্যমে এই মজা উপলব্ধি করতে পারুক। ব্যবসা শুরু করার প্রথমদিন থেকেই ব্যবহারকারীর চাহিদার বিষয়ে খেয়াল রাখাটা উন্নতির প্রধান ধাপ। কিছুদিন আগেও শুরুয়াতি ব্যবসায় হেলে-দুলে এগোনোর সময় ছিল, কিন্তু এই ২০১৫ সালে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেছে, প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই চাইছে একে অপরকে ছাপিয়ে যেতে। সকালের প্রথম আলো যেমন পুরো দিনের আবহাওয়া নির্ধারণ করে দেয়, তেমনি প্রথম পর্বের পরিকল্পনাই ঠিক করে দেয় ভবিষ্যতের লাভক্ষতি। উদ্যোগীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে নিজের প্রোডাক্ট লাইন যেন কাস্টমারের ভালবাসা হয়ে থেকে না যায়, সেটা যেন হয় তাদের অন্যতম চাহিদা। আর সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে পথ চলা শুরু করলে, পথ যতই লম্বা হোক না কেন, গন্তব্যে পৌঁছানটা খুব একটা কঠিন হয়না।

(লেখা - রাখি চক্রবর্তী, অনুবাদ - নভজিত গাঙ্গুলী)