কৃষ্টিসৃষ্টি-র সাফল্যের গুপ্ত রহস্য সততা
তিন যুবক একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন নিজেরা কিছু করে দেখাব। নিজেরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াব। ওঁদের অভিভাবকেরা মনে করেছিলেন, ওঁরা জীবনে বড় বেশি ঝুঁকি নিতে ফেলছেন। বাঁধাগতের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর যে স্বপ্ন ওঁরা দেখছেন, তা যদি শেষমেশ সফল না হয়, তাহলে হতাশা ওঁদের গ্রাস করে নিতে পারে। তেমন হলে ভবিষ্যৎটা প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যেতে পারে। এসব তিনতিন বছর আগের কথা। যখন তিন বন্ধু সবেমাত্র গড়ে তুলেছেন Kristi Shristi Designs Unlimited নামে একটি সংস্থা। সেই সংস্থা তিন বছরের ভিতরই বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পেয়েছে।
সংস্থাটি নিয়ে ভাবনা ও স্বপ্ন প্রথম দেখেন প্রবীর সাহা। প্রবীর নিজে একজন পেশাদার শিল্পী। ১৯৯৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে বিড়লা ভিস্যুয়াল আর্ট অ্যান্ড কালচার থেকে ডিপ্লোমা করেন। এরপর কর্মাশিয়াল আর্ট নিয়ে ডিপ্নোমা করেন। ইতিমধ্যে একাধিক সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় নিজের হাতের শিল্পকর্মের জন্যে প্রশংসিত হয়েছেন প্রবীর। সেরার শিরোপা পেয়েছে তাঁর হাতে আঁকা ছবি কিংবা ভাস্কর্য। প্রবীর বললেন, শিল্পকর্মই আমার মূলধন। বরাবরের ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করব। সেই স্বপ্ন খানিক সফল করতে পেরেছি। পাশে পেয়েছিল পাড়ার দুই বন্ধু প্রবীর ও আশিসকে। ওঁরাও লেখাপড়ার পাট শেষ করে নিজেরা কিছু একটা করতে চাইছিল। আশিস দাস যেমন বললেন, বিকম পাশ করার পরে চাকরি করছিলাম ঠিকই। কিন্তু আমারও ভীষণ ইচ্ছা ছিল নিজে কিছু করে নিজের পায়ে দাঁড়াব। ওই টানই আমাদের তিন বন্ধুকে মিলিয়ে দিয়েছে। krishti shristi ডিজাইনস আনলিমিটেড এখন আর শুধু স্বপ্ন নয়। বরং আমাদের স্বপ্ন যেন বাস্তব হয়েছে।
কলকাতার পুজো মানেই রকমারি প্রতিযোগিতা। তিন বন্ধুর হাতে গড়া সংস্থা krishti shristi ডিজাইনস আনলিমিটেড এই পুজো প্রতিযোগিতার বাজারে গেল শারদোৎসবে ৯টি শিরোপা পেয়েছে। এশিয়ান পেইন্টস শারদসম্মান থেকে আরম্ভ করে ২৪ ঘণ্টা, কলকাতা টিভি বা এবিপি আনন্দের শিরোপা পেয়েছে প্রবীরদের পুজো ভাবনা। প্রবীরদের তৈরি মণ্ডপসজ্জা সেরা মণ্ডপসজ্জা ও দেবীপ্রতিমা সেরা প্রতিমার সম্মান পেয়েছে। আদতে শিল্পী প্রবীর বললেন, বছরে আট লাখ টাকার কাজ তো করছিই। প্রধানত, অন্দরসজ্জার কাজ। এই বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতা। টিঁকে থাকাই যেখানে দায়, সেখানে আমরা কলকাতা বা রাজ্যের অন্যত্র কাজ পাচ্ছি। কিছুদিন আগেই একটা তিনতারা রেস্টুরেন্ট সাজিয়ে এলাম দুর্গাপুরেও। তার আগে হিমাচল প্রদেশে একটা রিসর্ট সাজিয়ে এসেছি। আসলে কাজের সুনামই কাজ এনে দেয়। তাছাড়া, আমি একজন শিল্পী। তথাকথিত ব্যবসায়ী তো আমি হব না। আমার দুই বন্ধু প্রবীর আর আশিসও এটা মনে করে। ফলে, আমরা অর্থনৈতিক লাভের আশায় কাজ করলেও সেই অর্থে ব্যবসা করি না। বহু মানুষের জীবিকাও নির্ভর করে আমাদের একএকটি কাজের ওপর।
বেলেঘাটার বাসিন্দা আশিস এবং প্রবীররা। বছরের কোনও সময় কাজ থাকে হাতে। কখনও কখনও বা কাজ থাকে না। ফাঁকা সময়টাকে ওঁরা লেখাপড়ার কাজে ব্যবহার করেন। প্রবীর জানালেন, পড়তে তো হয়ই। পড়াশোনা না করলে চলবে না। থিমের পুজোর আইডিয়াগুলো বই থেকেই পাই। তারপর আমি সেখানে সাজিয়ে প্রবীর আর আশিসকে দিই। আমার স্ত্রী মৌমিতাও কাজটার সঙ্গে থাকে। ভাবনা আমার একারই বলতে পারেন। তবে রূপায়ণের দায়িত্ব প্রধানত ওঁদের তিনজনের ওপর। মৌমিতা বললেন, ছোটবেলায় ছবি আঁকতাম। এখন সেই গুণটা স্বামীর কাজে লেগে যাচ্ছে। ভালোই লাগছে। আপনারা আর্শীবাদ করুন, আমরা যেন অনেকদূর পর্যন্ত এগোতে পারি।
কিন্তু, মোটে তিন বছরের ভিতর এই ঘোড়দৌড়ের বাজারে তিনজন স্বপ্ন দেখা যুবকের এগোনোর কাহিনিটা আকর্ষণীয়। ওঁরা জানিয়েছেন, কাজ করতে গিয়ে কখনও চালাকি করবার মানসিকতা রাখেননি ওঁরা। ফলে মানুষ তাঁদের বিশ্বাস করেছেন। ব্যাপারটা ভেঙে বললেন প্রবীর। তিনি জানালেন, প্রথমদিকে যাঁদের কাজ পেতাম তাঁদের দেওয়া অগ্রিম টাকাতেই কাজটা করতে হত। কয়েক খেপে টাকা দিতেন নিয়োগকারীরাই। লাভ থাকত কম। অনেককে দিয়েথুয়ে হাতে সামান্য টাকাই লাভ হয়।
টাকার অঙ্গে লাভ কম থাকার প্রধান কারণ হল, কাউকে বঞ্চিত না করে কাজ করবার মানসিকতা। উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে কর্মীদের সন্তুষ্ট করাটা তিন যুবকের krishti shristi ডিজাইনস আনলিমিটেডের অন্যতম প্রধান নীতি। আশিস বা প্রবীররা এই নীতিতেই ব্যবসা করে ভালো কাজ পাচ্ছেন। ওঁরা বললেন, একটি ভালো কাজের সুনাম থেকে আর একটি কাজ পাওয়ার সুযোগ দেখা দেয়। এভাবেই যোগাযোগগুলো ঘটে যাচ্ছে। সুনাম নষ্ট না করার একমাত্র পথ কাজের সম্পর্কে আন্তরিকতা।
অভিভাবকদের ভয় অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। ওঁরা বলেন, বাঁধা গতের বাইরে চলতে গেলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বাবা, মা বা অন্য অভিভাবকেরা ভয় তো পাবেনই। আমরা ওঁদের ভুলটা ভেঙে দিতে পেরে খুউব খুশি হয়েছি।