কলকাতায় 'ব্যবসার বাস্তুতন্ত্র' তৈরি করে দিতে চায় KSA
গ্রীষ্মের দুপুর। রবিবার। তেতেপুড়ে কলকাতার সবেধন নীলমণি স্টার্টআপ কাফে An Idea তে জড়ো হয়েছিলেন কম করে জনা চল্লিশ স্টার্টঅাপ উদ্যোগপতি। বয়স কারওরই ৩৫ এর বেশি নয়। সব থেকে কম বয়সের এক স্টার্টআপ উদ্যোগপতির বয়স ১৯ বছর। শহরটার নাম কলকাতা। যে শহর এতদিন এই বয়সের ছেলেমেয়েদের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে ক্ষেপে উঠতে দেখেছিল। আকাদেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে, কফি হাউসে, নন্দন চত্ত্বরে জড়ো হয়ে কবিতা আওড়াতে ছবি আঁকতে সিনেমার স্ক্রিপ্ট নাটকের প্লট নিয়ে তুমুল তর্ক করত যে যৌবন, এখন তারাই গলদঘর্ম হয়ে ব্যাবসার আইডিয়া নিয়ে মেতে উঠছে। এতো পরিবর্তনই। কিন্তু রাজনীতি নেই এই পরিবর্তি। কারও কোনও তিলমাত্র সহযোগিতাও নেই। আছে টিকে থাকার তাগিদ। এগিয়ে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছে। শহরটার নাম কলকাতা। স্টার্টআপ বাস পরে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু ওদের আগে উঠতে হবে বাসে। হুড়মুড় উঠে পড়ছে একের পর এক স্টার্টআপ। ন্যাসকম দশ হাজারি লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। ইওর স্টোরিও নেমেছে কোমর বেঁধে। আর এগিয়ে এসেছে এই শহরেরই তরুণ প্রজন্ম। ভিশি আদতে কলকাতার ছেলে। কাজের সূত্রে পড়াশুনোর সূত্রে বিদেশে ছিলেন দীর্ঘদিন। মার্কিন মুলুকে স্টার্টআপের ফুল্লকুসুমিত সংসারটা দেখে এসেছেন ভিশি। কলকাতায় ফিরেই তাই নেমে পড়েছেন এমন একটা কিছু করতে যাতে মজবুত হবে এই শহরের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম। পাশে পেয়ে গিয়েছেন বন্ধুদের। এগিয়ে এসেছেন আইনের ছাত্র, উদ্যোগপতি, সমাজেসেবা করতে একপায়ে খাঁড়া সুপার অ্যাকটিভ অশ্রুজিত বসু। সবাই মিলে শুরু করে ফেলেছেন কলকাতা স্টার্টআপ এরেনা।
রবিবার ১৭ এপ্রিল ছিল সেই এরেনারই বৈঠক। এক ডজন স্টার্টআপ এদিন পিচ করলেন কলকাতা অ্যাঞ্জেলসের চিফ অপারেটিং অফিসার সৌম্যজিত গুহর সামনে। কলকাতা তো বটেই কলকাতার বাইরে থেকেও কয়েকটি স্টার্ট আপ অংশ নিয়েছিল। ইয়োর স্টোরি বাংলার তরফে প্রতিনিধিত্ব করলেন ডেপুটি এডিটর হিন্দোল গোস্বামী। হিন্দোল স্টার্ট আপ দর্শন সম্পর্কে ইয়োর স্টোরির মনোভাব জানালেন স্বল্প কথায়। উইকলি টকে ছিল প্রশ্নোত্তরের পর্ব। মূলত, স্টার্ট আপগুলিকে প্রেরণা ও ভবিষ্যতে আরও পরিণতভাবে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যেই এই সাপ্তাহিক আলোচনার আয়োজন। একগুচ্ছ তরুণ উদ্যোগপতি তাঁদের সংস্থার কাজকর্ম ও নিজেদের দেখা অভিনব স্বপ্নগুলি পরস্পরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলেন। কোথায় দুর্বলতা আছে, সেইসব জায়গাগুলি চিহ্নিত করা হল। কোনও কোনও স্টার্ট আপ আইডিয়া স্তরে রয়েছে। কিন্তু তাদের আইডিয়া অভিনবত্বের জন্যে অবাক করেছে। আর সেইসঙ্গে কুড়িয়েছে শুভেচ্ছাও।
যে ডজন খানেক স্টার্ট আপ সংস্থা যোগ দিয়েছিল। তাদের ব্যবসা ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরে। তবে একটি জায়গায় প্রত্যেক সংস্থা ও উদ্যোগপতির মধ্যে মিল দেখা গেল। সকলেই স্বপ্ন দেখেছেন নিজের হাতে সংস্থাটি খাড়া করার। কিন্তু, কী সেই গুণ যা না থাকলে স্বপ্নের গতি খানিক দূর গিয়েই স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে? আদতে নতুন কিছু অভিনব ভাবে শুরু করাটা যেমন বড় কাজ, সেইসঙ্গে এও মনে রাখা দরকার, একটি গাছকে বড় করতে হলে নিয়মিত যত্ন নিতে হয়, তেমনই ভাবে সংস্থা দাঁড় করানোর জন্যে পুঁজির পাশাপাশি প্রয়োজন গবেষণার। সৌম্যজিত এদিন জোর দিলেন এই গবেষণার ওপরই। তাঁর সুপরামর্শ প্রেরণা দিল শুরুয়াতি সংস্থাগুলির তরুণ তুর্কিদের। ইনভেস্টরদের প্রতিনিধি সৌম্যজিৎ নিজেকে মেন্টর বলতে রাজি নন। কিন্তু যা করলেন এদিন তা শুধু একজন অভিভাবকই পারেন। নরমে গরমে নব্যগঠিত স্টার্ট আপগুলিকে সতর্ক করে দিলেন ভুলচুক ধরিয়ে দিলেন। পরামর্শ দিলেন কী হলে ভালো হত। কার কার সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি এই নানান বিষয়ে আগবাড়িয়েই শুধরে দিলেন পরম স্নেহে। তবে গবেষণার ওপরই বেশি জোর দিতে বললেন সৌম্যজিত। হুট করে বাজারে নেমে না পড়ে বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও তথ্য জেনে নেওয়াটা স্টার্ট আপগুলির সাফল্যের জন্যে অতি প্রয়োজনীয় একটি কর্তব্য বলে সতর্ক করলেন সৌম্যজিৎ। পাশাপাশি, তিনি এও জানিয়ে দিলেন, ব্যবসার সাফল্যের জন্যে সদাসর্বদা মাথায় রাখতে হবে ক্রেতা বা গ্রাহকের চাহিদা। উদ্যোগপতি শুরুতে নিজে কী স্বপ্ন দেখেছিলেন, একটা পর্যায়ের পরে তা আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। বরং, সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার মতো কাজ হল ক্রেতা বা গ্রাহক ঠিক কী চাইছেন, সেই সম্পর্কে স্টার্ট আপদের বিশদ সচেতনতা।
এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক, কারা এসেছিলেন এই উইকলি মিটে। আর কী করতে চান ওঁরা।
তরুণ উদ্যোগপতি অর্ণব খানের সংস্থার নাম ইনস্ট্যান্ট রাইড। সংস্থা একটি অভিনব আইডিয়া বাজারে আনতে চলেছে। সেটি হল টু হুইলার ট্যাক্সি। ইনস্ট্যান্ট রাইডের প্রতিষ্ঠাতা অর্ণব জানালেন, মার্কেট রিসার্চের কাজ শেষ। প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমোদনের বিষয়গুলিও ইতিবাচক। আশা করা যায়, আর কিছুদিনের ভিতরই টু হুইলার ট্যাক্সি বাজারে এসে যাবে।
বিশ্বজিৎ দে পেশায় একজন হেলিকপ্টার চালক। ওঁর সংস্থার নাম এডুরেড। এডুরেড স্কুল ও কলেজগুলির পড়ুয়াদের হোভারক্রাফট, ড্রোন বানানোর জন্যে প্রয়োজনীয় সহায়তা করছে। ইতিমধ্যে ভাল সাড়া মিলেছে বলে জানালেন বিশ্বজিৎ। শুধু এই রাজ্যই নয়, আইআইটি পাটনা বা আইআইটি গৌহাটিতেও তাঁদের পরিকল্পনা ছাত্র মহলে ভালো সাড়া ফেলেছে।
বাজঅ্যাব সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ। এটি একটি অনলাইন শপিং নেটওয়ার্ক। সিদ্ধার্থের স্বপ্ন, বাজঅ্যাবকে একটি ডিসকভারি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তোলা। সেই কাজে এপর্যন্ত কীভাবে এগিয়েছেন, তার খতিয়ান শোনা গেল।
পিস সার্ভে গ্রুপ নামে একটি স্টার্ট আপ কাজ করছে নানা ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রজেক্টে। সংস্থার তরফে উপস্থিত ছিলেন পি কে সাহা। এছাড়াও সার্ভের কাজে ব্যবহার করা হয় যে সমস্ত যন্ত্রপাতি সেগুলির মেরামতি করে থাকে পিস সার্ভে।
এছাড়া, এদিনের উইকলি টকে অংশগ্রহণকারী অন্য স্টার্ট আপগুলির মধ্যে ছিল অশ্রুজিতের সংস্থা আইপি মল, বিনয় মেমনের সংস্থা মেরা টিফিন কিংবা অরিজিত ও তাঁর দুই বন্ধুর সংস্থা ওয়াড্রো কেয়ার।
হয়তো সবার জানা তবু একটা ছোট্ট টিপস দিলেন সৌম্যজিৎ সেটা হল স্টার্টআপ গড়ার সময় পেশাদারদের নিয়ে দলবদ্ধভাবে বা টিম গড়ে কাজ করলে বিনিয়োগ পেতে সুবিধা হয়। এককভাবে কেউ স্টার্ট আপ গড়ে ইনভেস্টরের দ্বারস্থ হওয়ার চেয়ে একটি শক্তিশালী টিম থাকলে ইনভেস্টর সেই সংস্থার সঙ্গে কাজে আগ্রহী হন। কারণ, সংস্থার ভালোমন্দ ভবিষ্যতের দায়টা তখন নির্ভর করে একাধিক ব্যক্তির ওপর। ফলে, বিনিয়োগকারী সংস্থাও টাকা ফেরতের ব্যাপারে অনেকটাই আশ্বস্ত থাকে।