অন্য কিছু করার স্বপ্নে বিভোর 'খোয়াবনামা'
সকাল নটা থেকে রাত নটা অবধি চার দেওয়ালের চৌহদ্দির মধ্যে আবদ্ধ থেকে এমন কোনো কাজ করে যাওয়া যা ঠিক পছন্দের নয়; নিজের দিনরাতগুলোকে বাস- ট্রাম- ট্রেনের টাইম টেবিলের মধ্যে সাজিয়ে নেওয়া, অফিসে নিত্যদিন সময়মত হাজিরা, কিংবা সপ্তাহান্তের ছুটির রেশ নিয়ে সোমবার থেকে আরেকটা কর্ম-সপ্তাহের শুরুর বাঁধা বরাদ্দ জীবন কখনোই টানেনি তাঁকে। বরং তিনি চেয়েছিলেন অন্যকিছু করতে। এমন কিছু, যেখানে সর্বক্ষণ অন্যের কথামত চলবার দায় থাকবেনা। এমন এক জীবন, চেনা গন্ডীর চশমায় ধরা দেবেনা যা। পেশাগত অস্তিত্ব যেখানে থাকবে নিজের শর্তাধীন। আর তাঁর সেই চাওয়াগুলোকেই বাস্তব করেছে ‘খোয়াবনামা’।
“বাঁধাধরা চাকরির মধ্যে না ঢুকে, বরং অন্য কিছু করা যায় কিনা, সেই নিয়ে নানারকম জল্পনা কল্পনা দীর্ঘদিন ধরেই মাথার মধ্যে ছিল,” জানালেন অনলাইন বুটিক ‘খোয়াবনামা’র রুপকার লোকেশ্বরী দাশগুপ্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তনী মধ্য কুড়ির এই তরুণী পেশাগতভাবে মূলত নৃত্যশিল্পী। কিন্তু চেয়েছিলেন এর পাশাপাশি অন্যকিছুও করতে। স্থায়ী চাকরি বরাবরই তাঁর না-পসন্দ। “কি করা যায় সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলাম অনেকদিন ধরেই। তখন ২০১৪ এর মাঝামাঝি। এরকম সময়ে আমার এক বন্ধু, অনুজা আমাকে বলে যে আগস্ট মাসে ‘গ্যালারি গোল্ড’এ একটা প্রদর্শনী হবে। এবং চাইলে সেখানে কম টাকায় স্টল নেওয়া যেতে পারে। গয়নার পাশাপাশি টুকটাক কিছু পোশাকও রাখা যেতে পারে সেখানে। অনুজা জানতে চায় যে আমি ইচ্ছুক কিনা। আমি এর আগে বেশ কিছু ওয়েস্টকোট ডিজাইন করেছিলাম। এবং কিভাবে একটা বুটিক খোলা যায় সেই নিয়েও কিছু ভাবনা ছিল আমার। এখন অনুজার তাড়না আর প্রদর্শনীতে নিজের কিছু করবার হাতছানি – এই দুটোই আমার এলোমেলো ভাবনাচিন্তাগুলোকে বাস্তব করার সুযোগ এনে দিল। ওয়েস্টকোটের পাশাপাশি কিছু গয়নাও রাখব ভেবে সরঞ্জাম কিনে হাত লাগালাম গয়না তৈরিতে। গয়না ও পোশাকের পাশাপাশি নিজের ডিজাইন করা কিছু পোস্টারও রেখেছিলাম।প্রদর্শনীতে বেশ ভালো সাড়া পেলাম। আর মনে হল যে এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। ব্যাস, এভাবেই শুরু হল ‘খোয়াবনামা’র,” বললেন লোকেশ্বরী।
খোয়াবনামার এই যাত্রায় বন্ধুর পাশাপাশি তিনি পেয়েছেন মা’কেও। “প্রথম দিকে মা অনেক সাহায্য করেছেন। কিভাবে গয়না বানাব, তার পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করার পাশাপাশি গয়নার সূক্ষ কাজগুলো নিজে হাতে করেছিলেন। আর আমিও খুব সহজেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম ব্যাপারটাতে।”
লোকেশ্বরীর এই উদ্যোগে সবসময় পাশে থেকেছে তাঁর পরিবারের অন্যা ন্য সদস্যরাও। তা সে ক্রেতা সংযোগ গড়ে তোলা হোক কিংবা খোয়াবনামার জন্য কোনো নতুন পরিকল্পনা - পরিবারের সদস্যদের মতই একইরকমভাবে সাহায্য করেছে বন্ধুরাও, বললেন লোকেশ্বরী। গ্যালারি গোল্ডের প্রদর্শনী দিয়ে শুরু হবার পর লোকেশ্বরী অর্ডার পেলেন এক বন্ধুর বুটিকের জন্য।
“প্রদর্শনীতে বা ব্যক্তিগত পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে যাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল, তাদের একটা তালিকা বানিয়ে নিলাম এবং WHATSAPP এ নিয়মিত ভাবে তাদেরকে খোয়াবনামার নানান প্রোডাক্টের ছবি পাঠাতে শুরু করলাম। এভাবে অনলাইন অর্ডার পাওয়া শুরু হয়েছিল। আর তারপর ফেসবুকে একটা পেজ তৈরি করলাম। এইগুলো করার মধ্যে দিয়েই বিক্রির পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে গেল। বিশেষ করে ফেসবুক পেজ অনেকটাই সাহায্য করেছিল খোয়াবনামা’কে জনপ্রিয় করে তুলতে” জানালেন তিনি।
তবে শুধু অনলাইনেই সীমাবদ্ধ থাকতে নারাজ তিনি। বরং চান আগামীদিনে খোয়াবনামার একটি স্থায়ী বিপনণি তৈরি করতে। “কিন্তু তার জন্য আগে একটা জায়গা দরকার। আর কিছু আইনগত কিছু বিষয়ও দেখার আছে।”
লোকেশ্বরী ব্যক্তি হিসাবে নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়ে সচেতন। ভবিষ্যতে তিনি এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত করতে চান সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষদের। “নিজের ছোটো পরিসরে যেটুকু আমার পক্ষে করা সম্ভব, সেটা যাতে করতে পারি সেই চেষ্টাই করব,” বললেন তিনি। নিজের শিল্পী সত্তাকে তিনি বিচ্ছিন্ন এক অস্তিত্ব হিসাবে দেখেননা। আর তাই খোয়াবনামাকে তিনি পুষ্ট করতে চান নিজের সাংস্কৃতিক চেতনার বিনিয়োগে।
আগামীদিনে কিভাবে দেখতে চান খোয়াবনামা’কে? “ ছোট্টো ছিমছাম একটা বিপনণি, যেখানে হাতে বানানো গয়না, পোশাক, ঘর সাজাবার জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। একটা পরিসর, যেখানে তরুণ কোনো শিল্পী সুর তুলবে গীটারে, যেখানে নাচের সাবলীল গতি সঙ্গত করবে জানা অজানা বোলের, যেখানে বসবে আড্ডাচক্র, বা কোনো কোনো সন্ধ্যেয় থাকবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমি খোয়াবনামাকে দেখতে চাই সংস্কৃতির নানা স্রোতের ঘাত-প্রতিঘাত-মেলবন্ধন-আত্তীকরণের এক ব্যতিক্রমী পরিসর হিসাবে। আর সেই স্বপ্নের পথ চলার এই তো সবে শুরু।”