নেক্সটাইলস কন্যার সাফল্যের রহস্য
“And, when you want something, all the universe conspires in helping you to achieve it.”
― Paulo Coelho, The Alchemist
শুচিস্মিতা দাশগুপ্ত। স্কুল-কলেজ জীবন কেটেছে অ্যাডভার্টাইজিং দুনিয়ায় ঝড় তোলার স্বপ্ন দেখতে দেখতে। পরে কিছুদিন বিজ্ঞাপণ সংস্থায় কাজ করারও সুযোগ পান। শিবনাথ শাস্ত্রী কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর ব্র্যান্ড বিল্ডিং কমিউনিকেশনে ডিপ্লোমা করেন। কলকাতার একটি এজেন্সিতে আর্ট ডিরেকশন, প্রিন্ট প্রোডাকশনের কাজে যোগ দেন। কিন্তু অ্যাডভার্টাইজিংয়ের কাজ বেশিদিন ভাল লাগেনি। এরপর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কমিউনিকেশন মেটেরিয়াল তৈরির কাজ শুরু করেন শুচিস্মিতা। এসব করতে করতেই টেক্সটাইলের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। “আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুদের জন্য শাড়ি, ড্রেস মেটিরিয়াল ডিজাইন করতে শুরু করি। এরপর আরমানি, ডিকেএনওয়াই, কেনজো, সনিয়া রিকল, এট্রোর মতো সংস্থার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা হয়। তখন থেকেই নিজের কিছু করার তাগিদ ছিল। স্টাইল আর ফ্যাশনের হালহকিকত বুঝতে ভারতের নানা প্রান্তের পাশাপাশি নিয়মিত ইওরোপ যেতাম। অবশেষে ২০০৪ সালে জন্ম হল নেক্সটাইলসের।”
পরিবার ছিল মধ্যবিত্ত। বাবা ইস্টার্ন রেলে কাজ করতেন। মা স্কুল শিক্ষিকা। “আমার ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত কোনওদিনই মেনে নেননি বাবা-মা। বরং ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইএসের চেনা গতে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন আমাকে। তা সত্ত্বেও কখনও চাপ সৃষ্টি করেননি। তর্কবিতর্ক, বচসা, মান-অভিমান—সবই ছিল। আর আমিও আমার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। অবশেষে বাবা-মাও রাজি হয়ে গেলেন।” এরপরই চাকরি ছেড়ে দেন শুচিস্মিতা। প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৪০ হাজার টাকা, জেঠুর দেওয়া ৪০ হাজার আর বাবার দেওয়া ল্যাপটপ নিয়ে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ফ্যাশনের এই দুনিয়ায় পা রেখেই বুঝেছিলেন পথটা একেবারেই মসৃণ নয়।
“পুরুষশাসিত পেশায় মেয়েদের জায়গা করে নেওয়া কম চ্যালেঞ্জিং নয়। তাও আবার ব্যবসার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া। সাপ্লায়ার থেকে ক্লায়েন্ট সকলেই নয় আকাঠ মূর্খ মনে করত না হলে বাবা-মায়ের অপদার্থ সন্তান পয়সা ওড়াচ্ছে ভেবে আমল দিত না,” বলছিলেন শুচিস্মিতা।
সমস্যা এসেছিল আর্থিক দিক থেকেও। প্রাথমিক বিনিয়োগের পর হাতে আর টাকা ছিল না।ব্যবসায়িক বুদ্ধি বলতে যা বোঝায় তা উত্তরাধিকার সূত্রে পাননি। তাই ঠিক করলেন বিনিয়োগ করা টাকা বাজারে খাটাবেন। সেসময় নিজের সংস্থার জন্য বিজ্ঞাপণ কিংবা পিআর নিয়োগ করারও ক্ষমতা ছিল না। আদতে রাম্প ফ্যাশনে বিশ্বাসী নন, তবু পেশার তাগিদে বেশ কিছু শো করেছেন।
নেক্সটাইলস নামটার পিছনেও ইতিহাস রয়েছে। শুচিস্মিতা জানালেন, “যখন নেক্সটাইলস বাজারে এসেছিল তখন ফ্যাশন দুনিয়ায় সিন্থেটিক, মেশিনে তৈরি ফাইবারের রমরমা। কিন্তু হাতে তৈরি সুতি, সিল্ক, লিনেনের পোশাককেই প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলাম। ‘নেক্সট জেনারেশন টেক্সটাইল’-- সেই কনসেপ্ট থেকেই নেক্সটাইলস নাম রাখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এক বন্ধু।”
কুর্তি, ট্রাউজার, শাড়ি স্কার্ফ থেকে ড্রেস মেটিরিয়াল—মহিলা পুরুষ সবার জন্যই উন্মুক্ত দ্বার নেক্সটাইলসের। অনলাইনে অবশ্য সবথেকে বেশি বিক্রি হয় শাড়ির। শুচিস্মিতা জানালেন, তাঁর নেক্সটাইলস অন্যান্যদের থেকে আলাদা কারণ এখানে ক্লায়েন্টকে কোনও ফ্যাশন ফলো করতে হয় না। নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেন্ট ফলো করার সুযোগ পান তাঁরা। আর এই নিজস্বতাই তার ইউএসপি।
ধীরে ধীরে এই স্বকীয়তা টলিউডের তাবড় তাবড় সেলিব্রিটি, পরিচালক, প্রযোজকদের নেক্সটাইলসে টেনে এনেছে। তাই বিবর, চতুরঙ্গ, ল্যাপটপ, শব্দ, কাহানির মতো ছবির পোশাকসজ্জার সৌজন্যে নেক্সটাইলস। অহল্যা, অপুর পাঁচালি, কয়েকটি মেয়ের গল্প, কেয়ার অফ স্যার--- তালিকা কম দীর্ঘ নয়। ২০১৩ সালে মাদ্রিদ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে কয়েকটি মেয়ের গল্প ছবির জন্য বেস্ট কস্টিউম পুরস্কার পেয়েছেন ।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী ? জিজ্ঞাসা করলে কিছুটা চিন্তায় পড়ে যান। একটু পরই হেসে জানান, “একদম পরিকল্পনা করতে পারি না। তবে এত টাকা আয় করতে চাই যাতে অবসরকাল সরকারি চাকুরেদের মতো আরামে কাটে।”
ভবিষ্যত স্টার্টআপদের জন্য তাঁর পরামর্শ জানতে চাইলে আরও একবার শাহরুখ খানের বিখ্যাত সংলাপটাই গড়গড় করে আউড়ে দিলেন শুচিস্মিতা।