সিকিম যখন উদাহরণ, আমরা কেন নীলাবরণ?

সিকিম যখন উদাহরণ, আমরা কেন নীলাবরণ?

Friday January 29, 2016,

4 min Read

বাজার থেকে ফুলকপি কিনলে আজকাল সবজিওলাই বলেন পাতাগুলো ফেলে দিতে। কারণ যা কীটনাশক ব্যবহৃত হয় সেগুলো বিষ। ফলে এটা সর্বজন বিদিত।চাষে ব্যবহৃত বিষ প্রতিদিন খাদ্যের ভিতর দিয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে। আমি আপনি জানতেও পারছি না। আমরা পঙ্গু হয়ে যাচ্ছি। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

image


এরকম পরিস্থিতিতে বেশ কিছু সমাজসেবী সংস্থা এগিয়ে এসেছে। কৃষকদের বোঝাচ্ছে। সরকারও হাত গুটিয়ে বসে নেই। কিন্তু উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদে জৈব চাষের আর্জিতে কান পাততে তৈরি নন চাষিরা। ফলে বিষমুক্তির কী উপায় তা নিয়েই কপালে ভাঁজ বিশেষজ্ঞদের।

এরই মধ্যে গত ১৮ই জানুয়ারি একটি sustainable agriculture conference এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সিকিমকে দেশের প্রথম সম্পূর্ণ জৈব রাজ্য ঘোষণা করলেন। পশ্চিমবঙ্গের হাতে গোণা খবরের কাগজে এক কলম তিন সেন্টিমিটার লেখা হল। সংবাদ সংস্থা পিটিআই টেকের পর টেক পাঠালো। কিন্তু স্পাইক হয়ে গেল অধিকাংশ টেক। কারণ এখনও জৈব চাষ নিয়ে তেমন ভাবে জেগে ওঠেনি পশ্চিমবঙ্গ। গুগলে সার্চ করুন, জৈব চাষ নিয়ে রাজ্যের পরিসংখ্যান খুঁজুন ২০১০ এর পুরনো রিপোর্ট পাবেন। কোনও কাজের তথ্য হাতেই আসবে না। সিরিয়াসলি জানতে চাইলে ছুটতে হবে বিশেষজ্ঞদের কাছে।

কিন্তু জেনে রাখুন এই রাজ্যেই হাইব্রিড বীজের বিরোধিতা করে আন্দোলন সব থেকে তীব্র হয়েছিল। এই রাজ্যেই বিটি বেগুন নিয়ে সচেতনতার কাজ করেছিলেন ভরত মনসতার মত মানুষ। এখনও মিডলটন রোড দিয়ে যাতায়াতের পথে একবার দেখা করে আসি আর্থ কেয়ার বুক স্টোরের মিতভাষ এই ঋজু মানুষটার সঙ্গে। এখানে রুর আর্বান ফার্মিং নিয়েও প্রচুর কাজ হচ্ছে। বিকল্প চাষের অবকাশ তৈরি হয়েছে। ছাদে চাষ করছেন পশ্চিমবঙ্গের শহরের মানুষ। নিজেদের সবজি নিজেরাই ফলিয়ে নিচ্ছেন বিষমুক্ত আহারের আশায়। ক'দিন আগে রাজ্যের মন্ত্রী পূর্নেন্দু বসু ঘোষণা করেন নদিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা সহ বেশ কয়েকটি জেলায় ৩২ টি গ্রামকে চিহ্নিত করে অর্গানিক গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কিন্তু সদিচ্ছার ত্রিকোণমিতি হাইপোথিসিসের পিরামিড দাঁড় করায় বাস্তবের মাটি থেকে অনেকটা ওপরে। সেখানে জৈব চাষ গবেষণার বিষয়, পরীক্ষা নিরীক্ষার চৌহদ্দিতে আবদ্ধ। অন্যদিকে আয়তনে ছোট্ট একরত্তি রাজ্য সিকিম ৭৫ হাজার হেক্টর চাষের জমিতে শুধু জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে গোটা দেশকে দেখিয়ে দিতে পারে কাকে বলে এগোনো।

Sikkim Organic Mission এর এক্জিকিউটিভ ডিরেক্টর ডক্টর আন বালাগান জানালেন সিকিম গত বছর ডিসেম্বরেই সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে চাষের সুনাম অর্জন করে। ১৮ই জানুয়ারি বিষয়টির সরকারি ঘোষণা হয়। সিকিমকে জৈব রাজ্য ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।

'National Programme for Organic Production' এর নীতি এবং পদ্ধতি মেনে সিকিমে ধীরে ধীরে ৭৫ হাজার হেক্টর চাষের জমিতে জৈব উপায়ে কৃষিকাজ করা সম্ভব হয়েছে। সার্টিফায়েড জৈব কৃষিজমি তৈরি করা খুব সহজ ছিল না। বারো বছর আগে পাওয়ান চামলিং এর সরকার সিকিমকে জৈব রাজ্যে রূপান্তরের কথা ঘোষণা করে। পরবর্তীকালে রাসায়নিক সারের উৎপাদন এবং প্রয়োগ পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। কৃষকরা জৈব উপায় অবলম্বন করতে বাধ্য হন। বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে তাল রেখে জৈব কৃষিকাজ করা হয়। এগ্রিকালচার সেক্রেটারি খোরলো ভুটিয়ার মতে জৈবচাষ কৃষিকাজকে ধীরে ধীরে দূষণমুক্ত করে তোলে। দীর্ঘমেয়াদী ভাবে বহুমুখী চাষাবাদ সম্ভব হয়। অনেক রকমের ফসল আর ফল উৎপাদন করা যায়।

১০ বছরের গবেষণা বলছে প্রথাগত চাষের তুলনায় জৈবচাষজাত খাদ্যে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ ১৮০ ভাগ কম থাকে। জৈবচাষে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফসল উৎপাদন করা যায়। পেস্ট কন্ট্রোলও হয় বায়োলজিক্যাল পদ্ধতি মেনেই। জৈবসার হিসেবে পশুর হাড়ের গুঁড়ো আর ফুলের পাইরিথ্রিন এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ-নাশক আর পতঙ্গভুক প্রাণী কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্যের কারণে রাসায়নিক সার,অ্যান্টিবায়োটিক বা মানুষের মল-মূত্রের ব্যবহার বিশেষ করে নিষিদ্ধ।

জৈবচাষ চাষের জমির উর্বরতাও বাড়ায়। ফলে ফসলের উৎপাদনও বাড়ে। হিমাচলের পর্যটন শিল্পেও জৈবচাষ বিস্তর প্রভাব বিস্তার করেছে। বিভিন্ন রিসোর্টগুলো ইতিমধ্যেই নিজেদের জৈব রিসোর্ট বলে জানিয়েছে। পর্যটকরা এখানের বাগান থেকে নিজেরাই ফসল তুলে রান্না করে খেতে পারেন।

FAO ( Food and Agriculture Organization ), united nations এর সংস্থা। এখানকার ডিরেক্টর জেনারেল খাদ্য সুরক্ষা এবং মানুষের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেই বারংবার আশ্বাস যুগিয়েছেন জৈবচাষে আগ্রহী দেশগুলোর পাশে দাঁড়াবার।

১৯৭২ সালে ইন্টারন্যাশনাল জৈবচাষ সংস্থা International Federation of Organic Agriculture Movements (IFOAM) প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ সারা পৃথিবী জুরে জৈবকৃষি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। নব্বইের দশকে শুরু হয়ে ২০১২ অবধি বাজারে জৈব খাদ্যসামগ্রীর চাহিদা প্রায় ৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে ঠেকেছে। বার্ষিক ৮.৯% হারে বাড়ছে জৈব কৃষিজমির পরিমাণ। ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী সারা পৃথিবীর ৯ কোটি ১,০ লক্ষ একর জমিতে জৈব কৃষিকাজ হয় যা মোট কৃষিজমির মাত্র ০.৯%।

এবার একটু ভেবে দেখুন তো, আমরা... ঠিক কী কবছি... এই কি উপযুক্ত সময় নয় নিজেদের বদলে নেওয়ার?