শিশুদের অধিকারের প্রশ্নে CRY এর পাশে Bangla YourStory
…বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, এ হোক মিলনের কাহিনি
বাংলা নববর্ষে সবাইকে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।
নতুন বছর মানেই নতুন প্রতিশ্রুতি, নতুন শপথ নিয়ে নতুন করে শুরু করার উত্তেজনা। আমরা যে যেখানে যে কাজের সঙ্গেই যুক্ত থাকি না কেন, মাঝে-মধ্যেই নানা ধরনের প্রশ্ন ও সংশয় এসে আমাদের ঘিরে ধরে, গ্রাস করে প্রাত্যহিকতার ক্লান্তি। আমরা সঠিক লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারছি তো? বাধা-বিপত্তির সামনে পথ হারিয়ে ফেলছি না তো? এমনই নানা প্রশ্ন জমতে থাকে মনের মধ্যে। আর সত্যি বলতে কী, এই প্রশ্নগুলোই আমাদের ক্লান্তি কাটিয়ে এগিয়ে চলার রসদ জোগায়, উৎসাহের স্রোতের মুখ থেকে সংশয়ের পাথর সরাতে সাহায্য করে। কেমন হয়, নতুন বছরের প্রথম দিনটিকেই যদি আমরা বেছে নিই প্রতিবন্ধকতার এই পাথর সরানোর কাজে?
প্রথমেই বলি, বিকল্প সাংবাদিকতা, পরিভাষায় যাকে ‘অল্টারনেটিভ জার্নালিজম’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে আজকাল, সে পথে যাত্রা শুরু করেছে ‘ইয়োর স্টোরি বাংলা’। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন সম্ভাবনাদের খুঁজে বের করার লক্ষ্যে এ আক্ষরিক অর্থেই এক নতুন সূচনা। এ পথে লোক কম, এবং সে কারণেই হয়তো এ পথে এগনোর মধ্যে চ্যালেঞ্জ বেশি, উত্তেজনাও। আমাদের সংস্থা, ক্রাই – চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ-ও এমনই এক পথ বেছে নিয়েছিল, আজ থেকে সাড়ে তিন দশকেরও বেশি আগে। দেশের পিছিয়ে পড়া শিশুদের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে পথ হাঁটা শুরু করেছিলেন আমাদের প্রতিষ্ঠাতা, রিপ্পন কাপুর। ১৯৭৯ সালে, শুরুর সেই দিনে সংস্থার তহবিল বলতে ছিল মোটে ৫০টি টাকা, আর এক আকাশ-ভরা স্বপ্ন। সেখান থেকে শুরু করে আজ দেশের ২৩টি রাজ্যে, ২০০-রও বেশি সহযোগী সংস্থার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে ক্রাই। ইয়োর স্টোরি-ও বিভিন্ন ভাষায় তাদের অনলাইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে বাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পিছিয়ে পড়া শিশুদের মধ্যে থেকে ইতিবাচক সম্ভাবনার স্ফুলিঙ্গ খুঁজে বের করা ও শিশুদের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। এই অঙ্গীকারই ইয়োর স্টোরি ও ক্রাই-কে একসঙ্গে আরও পথ হাঁটার সুযোগ করে দেবে, নতুন বছরে এমন আশা করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত হবে না।
লিখতে-লিখতেই মনে পড়ল, আরও একটা মজার মিল রয়েছে ক্রাই এবং ইয়োর স্টোরি-র মধ্যে। দুটি নামের মধ্যেই ‘You’ একটা বড় জায়গা জুড়ে রয়েছে। ইয়োর স্টোরি যেখানে ‘ইউ’ অর্থাৎ আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প বলে, ক্রাই – Child Rights And You-ও বলে যে, ‘You’ অর্থাৎ আপনাকে ছাড়া আমরা সম্পূর্ণ নই। বলে, আসুন বাড়িয়ে দিন সহযোগিতার হাত। আসুন, সকলে মিলে শিশুদের বন্ধু হয়ে উঠি।
আগেই বলেছি, শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ক্রাই-এর এক এবং একমাত্র লক্ষ্য। স্বাধীনতার প্রায় সাড়ে ছ’দশক অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরেও এখনও অসংখ্য শিশু স্কুলে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিংবা স্কুলে গেলেও তারা যে সেখান থেকে তাদের শিক্ষার পাঠ সম্পূর্ণ করে বেরোতে পারবে, নিশ্চয়তা নেই তারও। একদিকে এর কারণ যেমন অপরিসীম দারিদ্র্য, তেমনই রয়েছে পরিকাঠামো-গত সমস্যাও। শিক্ষার অধিকার আইনে বলা রয়েছে প্রতিটি শিশুকে স্কুলের আওতায় নিয়ে আসতেই হবে, এবং প্রাথমিক স্তরে সেই স্কুলকে হতেই হবে বাড়ি থেকে দু’কিলোমিটারের মধ্যে। অথচ বাস্তব কী বলছে? দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও এমন অসংখ্য গ্রাম রয়েছে যেখানে স্কুল নেই। বা হয়তো স্কুলের কাঠামোটুকুই আছে, কিন্তু নেই ক্লাসঘরে চেয়ার-টেবিল ও ব্ল্যাকবোর্ড, নেই বিদ্যুৎ, পরিশ্রুত পানীয় জল, শৌচালয়, নেই যথেষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। গত কয়েকবছরে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে অবশ্যই, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়। একই কথা বলা যায় শিশুস্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়েও। এমনকী শিশু-সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে সরকারি স্তরে রীতিমত নাড়াচাড়া শুরু হলেও, এখনও দেশ থেকে শিশুশ্রম অবলুপ্ত হয়নি, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা যায়নি, শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের মাত্রাও ক্রমবর্ধমান। বেশিদূর যেতে হবে না, এই পশ্চিমবঙ্গেই বাল্যবিবাহ, শিশুপাচার, শিশুদের বিরুদ্ধে যৌন-নিগ্রহের ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত। কী ভাবে প্রতিকার হবে এর?
কীভাবে শিশুরা ফিরে পাবে তাদের শৈশব, তাদের বেঁচে থাকা ও বড় হয়ে ওঠার অধিকার? এ দায়িত্ব কি শুধুমাত্র সরকারের, নাকি সাধারণ নাগরিকদেরও সেখানে বড় ভূমিকা থাকবে? আমি দরিদ্র, কিন্তু কেবল সেই কারণেই কি আমার শিশুটিকে আমি স্কুলে পড়তে না-পাঠিয়ে ঠেলে দেব লেদ-মেশিনে কাজ করতে? মেয়েকে, সে কেবলমাত্র মেয়ে বলেই, পড়াশোনা না-শিখিয়ে বসিয়ে দেব বিয়ের পিঁড়িতে? আইন প্রণয়নের দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু তাকে বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে আমার কি কোনও দায়ই থাকবে না?
আসুন, নতুন বছরে আমরা সবাই মিলে এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে বসি। সময় লাগবে হয়তো, কিন্তু সেই ভয়ে শুরুটাই যদি না-করি, তাহলে সমাধানে পৌছঁনোর রাস্তাটা ফুরোতে আরও অনেক সময় লেগে যাবে।