রত্নাবলীর 'দারিচা'য় বাংলার লোকসংস্কৃতি
ভারতীয় প্রাচীন ঐতিহ্যের কতো যে মূল্যবান সামগ্রী শুধুমাত্র সংগ্রহ ও সঙ্কলনের অভাবে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সুপ্রাচীন লোকশিল্পের বিপুল ঐতিহ্য যে কতো সহস্র স্রোতধারার চলমান রূপ পরিগ্রহ করে কত দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, একে অপরের মধ্যে লীন হয়ে গেছে ও চিরতরে হারিয়ে গেছে তার হিসেবও কেউই রাখেনা। না, কেউ রাখেনা বলা ভুল, কেউ কেউ রাখেন। যেমন রত্নাবলী বসুর দারিচা ফাউন্ডেশন। হাতে গোনা গুটিকয় মানুষ এখানে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছেন সংস্কৃতির শিকড়ের সন্ধানে।
দারিচা একটি অলাভজনক সংস্থা। যাত্রা শুরু ২০১৩ সালের এপ্রিলে। যদিও স্বপ্ন দেখার শুরুয়াত আরও বছর দুই তিন আগে। আর সেই স্বপ্ন দেখার কারিগর যিনি তাঁর নাম রত্নাবলী বসু।
২০১০ সাল থেকে আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে ওয়েব ম্যানেজার হিসাবে কাজ করার সুবাদে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আর্কাইভিং ও তার নানা প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে রত্নাবলীর বিস্তারিত জ্ঞান ছিলই। আর এর সঙ্গে ছিল তাঁরই মামাতো ভাই শিল্পী ও ডিজাইনার প্রয়াত অভিজিৎ গুপ্তের অনুপ্রেরণা, যিনি আশির দশক থেকে লোকশিল্প গবেষণায় নিজের মন প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। অসম থেকে অরুণাচল হয়ে পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্পের বিস্তৃত মানচিত্র চষে বেড়াতেন। অভিজিতের অনুপ্রেরণায় সেই সময় থেকেই রত্নাবলীর মাথায় এই চিন্তা ঢোকে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কে যদি আর্কাইভিং করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা বিশ্বের অজস্র শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয় তাহলে আজকের এই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এর চণ্ডীমণ্ডপে গ্রাম বাঙলার লোকগানকেই বা পরিবেশন করা যাবেনা কেন?
এই ভাবনা থেকেই গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র বাউল ফকির পটুয়া কবিয়াল কীর্তনিয়া ছৌ এবং অন্যান্য আরও বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর প্রান্তিক বিনোদনের আবহমান ঐতিহ্যকে সংগ্রহ ও ইন্টারনেটের দুনিয়ায় উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রচেষ্টায় সামিল হন রত্নাবলী।
২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে চাকরির সুস্থির জীবন ছেড়ে খুলে দিলেন নিজের জীবনের এক নতুন জানালা। উর্দু ভাষায় যাকে বলে ‘দারিচা’। আর অচিরেই এই খোলা জানালা দিয়ে ক্রমে আলো আসতে শুরু করল। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হয়ে গেল দারিচা ফাউন্ডেশানের ওয়েবসাইট।
বর্তমানে দারিচার মূল কাজ ভারতীয় লোক ও আদিবাসী শিল্প ও সংস্কৃতির নথিবদ্ধকরন (ডকুমেন্টেশান), সংগ্রহ আর প্রচার। এবং এই মুহূর্তে তাঁরা তাঁদের সামর্থ্য মত ছোট্ট দল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে ঘুরে এই কাজ করে চলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে নদিয়ার বাউল-ফকিরি সম্প্রদায় থেকে কোচবিহারের মোখা বাঁশি, মেদিনীপুরের চিত্রকর সম্প্রদায়ের পটচিত্র, পুরুলিয়ার ছৌ নাচ আর ঝুমুর গান, চব্বিশ পরগণার পুতুল নাচ, বাঁকুড়ার দশাবতার তাস, বীরভূমের রায়বেঁশে, মেদিনীপুরের গয়না বড়ি।
এই বিস্তৃত লোক-ঐতিহ্যের সংসারকে এক ছাতার তলায় আনা তো চাট্টি খানি কথা নয়। তবে রত্নাবলীও দমবার পাত্রী নন। তাঁর নিজের কথাতেও শোনা গেল তারই প্রতিধ্বনি, “দারিচার এই নাতিদীর্ঘ যাত্রাপথে আমাদের বহু বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করতে হয়েছে, প্রতি মুহূর্তে ঘাড়ের কাছে অনুভব করেছি অনিশ্চয়তার শীতল নিঃশ্বাস—কিন্ত আমরা বরাবর নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছি এবং নিজেদের এগোনোর পথে কোনও কিছুকেই বাধা হিসাবে মনে করিনি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটা নিখাদ ও প্রকৃত গবেষণালব্ধ তথ্যভিত্তিক ওয়েব পোর্টাল তৈরি করা যার মাধ্যমে লোকশিল্প ও লোকশিল্পী উভয়েই উপকৃত হবে। আর সেই লক্ষ্যে আমরা মন প্রাণ উজাড় করে কাজ করে গেছি...”
হ্যাঁ, গল্পের মত শোনালেও আর্থিক সংকট ও লোকবলের সমস্যা নিয়েই রত্নাবলী প্রাণের আনন্দে কাজ করে চলেছেন। আর এই কাজের জন্য একদিকে যেমন তিনি পেয়েছেন তাঁর স্বামী ও দুই সন্তান সহ গোটা পরিবারের সম্পূর্ণ সহযোগিতা, তেমনই পেয়েছেন অসংখ্য বন্ধুর দেওয়া ঐকান্তিক উৎসাহ। নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে এগুলোই ওঁকে সাহায্য করেছে। আর এই একাগ্রতাই এনে দিয়েছে সাফল্যের স্বাদ।
সারা বাঙলা থেকে বাছাই করা প্রায় দেড়শ জন লোকশিল্পীকে তাঁরা দারিচার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। যার ফলে দারিচা ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে একদিকে যেমন দুঃস্থ ও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শিল্পীরা উপকৃত হচ্ছেন, তেমনই দেশ বিদেশের বহু রসজ্ঞ ও লোকসংস্কৃতি গবেষণায় আগ্রহী মানুষও দারিচার এই সদর্থক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে কার্পণ্য করেননি। এর পাশাপাশি অন্যান্য বহু সংস্থাও তাদের প্রয়োজনে দারিচার কাছ থেকে তথ্য ও উপাদান ধার নিয়েছে। যাকে নিঃসন্দেহে কাজের সাফল্য হিসাবেই দেখছেন রত্নাবলী। এছাড়া গত দু’বছর ধরে রত্নাবলী কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে ও আর্থিক সহযোগিতায় দারিচার পক্ষ থেকে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী উপজাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংগ্রহ ও সংকলনে কাজ করে চলেছে।
যদিও নিজের সাফল্য নিয়ে মাথা ঘামান না প্রচার বিমুখ সদ্য ষাটে পা দেওয়া রত্নাবলী। বললেন, “কাজের জন্য প্যাশানটাই আসল। প্যাশান যদি থাকে তাহলে সাফল্যও একদিন না একদিন আসবে।” আর এই জীবনদর্শন কে হাতিয়ার করেই তিনি ইন্টারনেটের দুনিয়ায় খুলে দিয়েছেন বাঙলার আবহমান লোকসংস্কৃতির এক রঙিন 'দারিচা'।