আয়ুবস্যারের সংগ্রহে সমৃদ্ধ প্রত্নতত্ত্ব গবেষণা
পাক্কা সাড়ে পাঁচ ফুট। শ্যামলা বরণ। গায়ে সবসময় একটা ফতুয়া। কখনও বসে নেই। কিছু না কিছু করছেন। সদালাপি সদাব্যস্ত এই মানুষটির নাম মুহম্মদ আয়ুব হোসেন। কটোয়া মহকুমা কার্যালয়ের করণিক ছিলেন। সেই কাজ করতে করতেই এক অদ্ভুত নেশায় পেয়ে বসে তাঁকে। তখন মধ্য যৌবন। সেই যে শুরু, আজও অজয় নদের ধারে প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহে বুঁদ হয়ে থাকেন আয়ুব স্যার। গড়ে ফেলেছেন সংগ্রহশালা। তাঁর সেই সংগ্রহভাণ্ডার গড়ে তোলার কাহিনী শুনব আজ।
কাটোয়া মহকুমা কার্যালয়ে এই সেদিনও ব্যস্ত পায়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত তাঁকে। দরকারি কাজে এসে অনেকেই খোঁজ করতেন সদালাপি মুহম্মদ আয়ুর হোসেনের। কাজের ফাঁকে ব্যক্তিগত সুখ-দুখের গল্পও সেরে নিতেন। তেমনই একদিন মঙ্গলকোটের এক ভদ্রলোক তাঁকে প্রাচীনযুগের পোড়ামাটির কয়েকটি পাত্র দেখান। সেই দেখাই গেঁথে গেল মনে। তারপর আর থামানো যায়নি। চাগাড় দিয়ে উঠল আয়ুবের মধ্যে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা এক অদম্য অভ্যেস।
আয়ুবের তখন মধ্য যৌবন। শুরু করে দিলেন প্রত্নসংগ্রহশালা গড়ে তোলার কাজ। কেতুগ্রাম থেকে মঙ্গলকোট, চাণ্ডুলি থেকে দাঁইহাট, অজয় নদের ধার দিয়ে ওই বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রত্নসামগ্রী সংগ্রহে বুঁদ হয়ে থাকেন। গত সাড়ে পঁয়ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রত্ন সংগ্রহের এই নেশাই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, জনপদ থেকে জনপদে ছুটিয়ে বেড়িয়েছে মানুষটিকে। কোথাও কোনও পুকুর কাটা হলেই হাতে ছাতা নিয়ে চলে যেতেন সেখানে। যদি কিছু ওঠে! অদ্ভুত এই নেশাই গ্রামে এখন একনামে পরিচিত করে তুলেছে ‘আয়ুবস্যার’কে। সরকারি আধিকারিকদের কাছেও পরিচিত নাম।
কাটোয়া মহকুমা গ্রন্থাগারে গেলে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সঙ্গে বাড়তি পাওনা অবনীন্দ্র প্রদর্শশালা। আয়ুবের প্রাণের তাগিদের ফসল এই প্রদর্শশালাটি। ইতিহাসের ছাত্র ছাড়াও যারা প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী তাঁদের চোখ এড়ায় না এই সংগ্রহশালার অমূল্য সংগ্রহগুলি। গুপ্তযুগ, কুশানযুগ, পালযুগ, সেনযুগ সহ বহু পুরনো আমলের মুদ্রা, পোড়ামাটির জিনিসপত্র, পোড়া চাল, চিত্রলিপি, বিভিন্ন ধরনের ফসিল-কী নেই এই সংগ্রহশালায়। আয়ুবের হাতে গড়া দুষ্প্রাপ্য প্রত্নসামগ্রীর এই সংগ্রহশালার পূর্ণ মর্যাদা দিতে মহকুমা তথ্যসংস্কৃতি দফতর উদ্যোগ নিতে চলেছে। প্রত্নসামগ্রীগুলিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে।
আয়ুব হোসেনের এই সংগ্রহশালা নিয়ে মহকুমা গ্রন্থাগারের সম্পাদক তুষার পণ্ডিত সবচেয়ে বেশি তৎপর। ‘প্রত্নসন্ধানী গবেষকরা, ইতিহাস পড়ুয়ারা এই সংগ্রহশালা থেকে হাতে কলমে অভিজ্ঞতা বাড়ানোর সুযোগ পাবেন। সেই সঙ্গে আমরা মহকুমা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে চিঠি পাঠাচ্ছি, যাতে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এসে প্রত্নসংগ্রহের সম্ভার দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়’, বলছিলেন তুষারবাবু।
সরকারিভাবে তাঁর এই প্রচেষ্টাকে মর্যাদা দেওয়ায় উচ্ছ্বসিত প্রত্নগবেষক মুহম্মদ আয়ুব হোসেনও। ‘মহকুমা শহরে বিশেষ করে কাটোয়ার মতো মফস্সল এলাকায় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় আমি অভিভূত। ওদের সহযোগিতা না হলে এই দুষ্প্রাপ্য সম্ভার কালের নিয়মে নষ্ট হয়ে যেত। সংগ্রহশালা থেকে মানুষ উপকৃত হোক, তাহলেই সার্থক হবে আমার প্রচেষ্টা’, বলছিলেন গর্বিত ‘আয়ুবস্যার’।