মৌখিক তিন তালাকের বিরুদ্ধে লড়ছেন মেয়েরাই
তিনবার মুখে তালাক উচ্চারণ করছেন পুরুষ। এর জেরে প্রায়শই বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। আর তালাক পাওয়া সেই মেয়েটি পড়ছেন মহাবিপদে। তাঁকে তো মুখে মুখে তিন-তিনবার তালাক বলেই দায়দায়িত্ব থেকে খালাস স্বামী। এমন ঘটনা ঘটছে এদেশের সর্বত্রই। এই রাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়।
এমনভাবে বিবাহবিচ্ছেদ যে বেআইনি কাজ তা নিয়ে প্রচার চালাচ্ছেন মুসলমান মেয়েরাই। হাওড়া নলপুরে নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চালান মুসলিম তরুণী মেয়েরা। ওই সংস্থার তরফে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, হাওড়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার গ্রামে গ্রামে চলছে মৌখিক তালাকের বিরুদ্ধে প্রচার ও সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ।
নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের সম্পাদিকা রহিমা বিবি বললেন, এটা সত্যি যে, ইসলামে মুসলমান পুরুষ চারটি পর্যন্ত বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু, তা শর্তসাপেক্ষ। বহুবিবাহের পরে পুরুষ তাঁর প্রত্যেক বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গত আচরণ বা তাঁদের প্রতি সুবিচার করতে অপারগ হলে একটি বিবাহের নির্দেশ রয়েছে। তাছাড়া, মৌখিকভাবে তিন তালাক দিয়ে স্বামী স্ত্রীকে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না বলেও ইসলামে স্পষ্ট নির্দেশ আছে। মৌখিক তিন তালাক কোনওভাবেই অনুমোদিত নয়।
Read Related Story
রহিমা বিবি বাংলার মুসলিম মেয়েদের রোল মডেল
নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট সমাজসেবী অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম বললেন, মৌখিক তালাক অনুমোদিত না হলেও হামেশাই মেয়েদের তাঁর শিকার হতে হচ্ছে। পুরুষ মানুষের খামখেয়ালিপনার জেরে আক্রান্ত হচ্ছেন নিরীহ মেয়েরা। ইসলামে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমোদন আছে। সবরকম চেষ্টা করেও যদি বিয়ে টিঁকিয়ে রাখা না যায়, সেক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ অনুমোদিত। পুরুষমানুষ রাগের মাথায় কিংবা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তালাক দিলে সেও অনুমোদিত নয়। একসঙ্গে রাতারাতি তিন তালাক দিয়ে স্ত্রীকে সম্পত্তি-সহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করাও ইসলামে অনুমোদিত নয়।
এই রাজ্যেও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ আর্থ-সামাজিকভাবে অনেকটাই পিছিয়ে। যেখানে পুরুষেরই সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব রয়েছে, এই পরিস্থিতিতে মেয়েদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। রহিমা জানালেন, নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের তরফে রাজ্যের চারটি জেলায় মৌখিক তা্লাকের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচার চালাচ্ছেন অন্ততপক্ষে ২০০জন স্বেচ্ছাসেবী। বলে রাখা ভালো এই যে, আলোকপ্রাপ্ত যে সমস্ত মেয়েরা নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্রের তরফে প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁরা সকলেই মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
কীভাবে চলছে প্রচারের কাজ? তার ফলাফলই বা কী? জানা গেল, গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা দরিদ্র মুসলমান পরিবারের অভিভাবকেরা এখনও বহুক্ষেত্রে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিয়ে দায় সারছেন। অভিভাবকেরা ১৩-১৪ বছর বয়সেই মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই মেয়েদের অনেকে লেখাপড়ায় আগ্রহী হলেও, অভাবের তাড়নায় প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই এঁদের একটা বড় অংশকে ড্রপ আউটের দলে নাম লেখাতে হচ্ছে। তাছাড়া, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মেয়েদের মতো ঘরের ভিতরও মুসলমান মেয়েরা নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
মেয়েদের ওপর চলা এইসব অবিচারের বিরুদ্ধে কাজে নেমে নারী ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র পাশে পেয়েছে ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের মতো সর্বভারতীয় সংগঠনকে। একবার দেখে নেওয়া যাক, মেয়েদের ওপর চলা বৈষম্যের ছবিটা। এস বানু। বয়স ২৫। আর্থিকভাবে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বানু। বানুর মতো একই ধরনের নিপীড়নের শিকার এইচ খাতুন। ২০ বছরের খাতুন হাওড়ার বাসিন্দা। এঁদের দুজনেই বিয়ের সামান্য কিছু সময় পরে মৌখিক তালাকের শিকার হয়েছেন। জানা গিয়েছে, এমনকি ফোনেও তিন তালাক দিচ্ছেন পুরুষ। এদিকে তালাক পাওয়া মেয়েরা অধিকাংশ ঘটনায় কোনও রকম ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। ফলে, প্রধানত স্বামীর ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল মহিলারা মৌখিক তালাকের পরে একাধিক নাবালক-নাবালিকা সন্তান নিয়ে পড়ছেন বিপদের অথৈ সাগরে।
নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের মতো সংগঠনের তরফে দাবি তোলা হয়েছে, এভাবে তালাক দেওয়া চলবে না। ভারতীয় মুসলি ম মহিলা আন্দোলনের এই রাজ্যের আহ্বায়ক হিসাবে কাজ করছেন রহিমা। রহিমা বললেন, হাওড়া-সহ যে চারটি জেলায় আমাদের স্বেচ্ছাসেবক মেয়েরা চেতনা সৃষ্টির কাজ করছেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভালোই সাড়া পাচ্ছেন তাঁরা। বাল্যবিবাহ এবং মৌখিক তালাকের মতো প্রথা বাতিল করার কাজে নেমে স্বেচ্ছাসেবীরা গ্রামীণ এলাকাগুলিতে স্থানীয় মসজিদের ইমামের কাছেও দরবার করছেন। অনেকক্ষেত্রে সহযোগিতাও মিলছে।
অন্যদিকে, তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলতে সরকারি প্রকল্পগুলিতে ওঁরা কীভাবে কাজ পেতে পারেন, সেই বিষয়ে নিয়মিতভাবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। নারী ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের ফিল্ড সুপারভাইজার আসলেমা খাতুনের কথায়, আমরা মেয়েরা জাগছি। সেইসঙ্গে চেষ্টা করছি অন্যান্য মেয়েদের কাছেও ওই অগ্রসরের বার্তা পৌঁছে দিতে। আগামী দিনে একশো শতাংশ সাফল্যই আমাদের লক্ষ্য।
বর্তমানে কাজের বাধাটা কী, তা জানতে চাইলে জাহানারার মতো প্রবীণা সমাজকর্মী বললেন, মেয়েদের কাজ করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বিপত্তি হল পুরুষ মানুষের একাংশের কটূক্তি। আসলে যে মেয়েটি ঘরের বাইরে কাজ করছেন, তাঁর চরিত্র সম্পর্কে পুরুষ মানুষের একাংশের সন্দেহ ও সংশয় তো আছেই।
তবু, মেয়েদের পৃথিবী পাল্টাচ্ছে। ঘরেবাইরে নানান বাধা ও শোষণের যথাযথ মোকাবিলা করে অধিকারের লড়াইয়ে সামিল এখন এই রাজ্যের বাসিন্দা মুসলমান মেয়েরা।