শুভব্রত‍’র গবেষণায় ডায়াবেটিসে অব্যর্থ গুলঞ্চ

টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া। বস্তুটা কী জানেন? প্রাচীন আয়ুর্বেদে এর বিস্তর গুণের কথা লেখা আছে। মূলত হজমিকারক হিসেবে। কলকাতার এক বিজ্ঞানীর গবেষণায় বেরিয়ে এল এই গাছের আসল রহস্য। উনি বলছেন এর প্রয়োগে সেরে যাবে ডায়াবেটিস। আজ্ঞে হ্যাঁ এটি গুলঞ্চ গাছ। আর বিজ্ঞানীর নাম শুভব্রত সেনগুপ্ত।

শুভব্রত‍’র গবেষণায় ডায়াবেটিসে অব্যর্থ গুলঞ্চ

Thursday February 25, 2016,

3 min Read

পরিসংখ্যান বলছে আগামী ২০ বছরে বিশ্বের ডায়াবেটিক জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ হবেন ভারতীয়। বর্তমানে ভারতে ডায়াবিটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৬ কোটি। ২০৩০ সালে সেই সংখ্যা পৌঁছবে ১০ কোটিতে। এমন হাড় হিম করা পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে ডায়াবেটিস মেলিটাস টাইপ টু‍‍‍-র ব্যপকতা। আর এরজন্য অনেকটাই দায়ী জীবন‌যাত্রা আর খাদ্যাভ্যাস। ডায়াবেটিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্থূলতার সমস্যাও। কীভাবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নিয়ে নিরলস গবেষণা চলছে বিশ্বজুড়ে। ১৯৯১ সাল থেকে সেই কাজ করে চলেছেন গবেষক শুভব্রত সেনগুপ্তও। গুলঞ্চ গাছের পাতা আর কোষ নিয়ে তাঁর নিরলস গবেষণায় উত্তরটাও খুঁজে পেয়েছেন এই প্রবীণ গবেষক। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনেক আগেই গুলঞ্চ গাছে হজম সহায়ক উপাদান খুঁজে পেয়েছিল। এবার প্রফেসর সেনগুপ্ত ডায়াবেটিস আর ওবেসিটির অব্যর্থ ওষুধের সন্ধান পেলেন।

image


আদতে ছিলেন বাংলাদেশের সিলেটের বাসিন্দা। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে স্বপিরবার এদেশে চলে আসেন শুভব্রত সেনগুপ্ত। মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯৬৪ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে রসায়নে স্নাতক। ১৯৬৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে বায়োকেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজিতে দীর্ঘদিন গবেষণা করেন। ১৯৭৩ সালে গবেষণা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান ডিএসসি-তে তাঁকে সম্মানিত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত থেকে ইয়ং সায়েন্টিস্ট পুরস্কার পান। ২০০৬ সালে আইআইসিবি থেকে অবসর নেন।  তারপর থেকে হেরিটেজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। ১১৪ টি রিসার্চ পেপার পেশ করেছেন। ভারত ও আমেরিকায় ১৭টি পেটেন্ট রয়েছে তাঁর।

গুলঞ্চ গাছ হজমশক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে। একথা আর্য়ুর্বেদ শাস্ত্র অনেক আগেই বলেছে। ১৯৯১ সালে আইআইসিবি‍র পরীক্ষাগারে সেই গুলঞ্চ গাছ নিয়ে কাজ শুরু করেন শুভব্রতবাবু। কিছুদিনের মধ্যেই জানতে পারেন, গুলঞ্চ গাছ অ্যামাইলেজ বা শ্বেতসার হজমকারী উৎসেচকের আড়ত। এর থেকেই প্রথম জানা ‌যায় যে শুধু টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়াই নয়, অনেক গাছের কোষেই অ্যামাইলেজ উৎসেচক রয়েছে। ২০০২ সালে আমেরিকায় সাড়া ফেলেছিল এই গবেষণা। তবে শুভব্রতবাবু মনে করেন, আজকের দুনিয়ায় হজমে সাহায্যকারী গাছের খোঁজ মেলাই যথেষ্ট নয় যদি না তার ব্যবহার, ডোজ এবং গুরুত্ব সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা যায়। তবে আধুনিক চিকিৎসাজগতে এই গবেষণা যে নতুন দিশা খুলে দিয়েছিল তা অকপটেই বললেন তিনি। “এরপর গাছটির পাতার ওপর কাজ শুরু করি। দীর্ঘ গবেষণার পর আমি জানতে পারি, টি কর্ডিফোলিয়াতে জৈব সক্রিয় যৌগ রয়েছে। তার নাম স্যাপোনারিন। এটা আসলে অ্যামাইলেজকে কাজে বাধা দেয়। এটি শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা কমাতে শুধু সাহায্যই করে না, এটি একটি অ্যান্টঅক্সিডেন্ট। যেটা ডায়াবেটিসের বাজারলভ্য ওষুধগুলিতে পাওয়া যায় না। এই আবিষ্কার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রশংসা কুড়িয়েছিল,” বলছিলেন প্রফেসর শুভব্রত‍।

টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে এর কা‌র্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত নন শুভব্রতবাবু। কিন্তু টাইপ টু ডায়াবেটিসে যে এটি রক্তচাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে তা হলফ করে বলছেন তিনি। আমাদের শরীরে লিপাস বলে একটি এনজাইম আছে যা ফ্যাট ভেঙে ফ্যাটি অ্যাসিড আর গ্লিসারল তৈরি করে। সেকারণেই স্থূলতার সমস্যা দেখা দেয়। শুভব্রতবাবুর দাবি, টি কর্ডিফোলিয়ায় এমন উপাদান আছে যা লিপাজকে কাজে বাধা দেয়। ফলে ফ্যাটযুক্ত খাবার খেলেও স্থূলতার সমস্যা হয় না। পেটেন্ট পাওয়ার অপেক্ষায় শুভব্রত বাবু। তারপরই এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বাজারে পাওয়া যাবে। আর তাতে উপকৃত হবেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। সেদিন আরও একটি পালক জুড়বে বাঙালি বিজ্ঞানী শুভব্রত সেনগুপ্তর মুকুটে।