পূজার স্বপ্নের ডানা ‘দেবাত্রি’ বুটিক
ও পূজা। পূজা দেবনাথ। দেখতে সুন্দর, মিষ্টি স্বভাব। মানুষকে আপন করে নেবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা রাখেন। ওঁর একটা জামাকাপড়ের বুটিক আছে। দেবাত্রি বুটিক। ছোটবেলা থেকেই পূজা ব্যবসায়ী পরিবারে শ্বাস নিচ্ছে। বাবা, ভাই ব্যবসা করেন। বিয়ে হয় যে পরিবারে তাঁরাও শাড়ির ব্যবসায়ী। পূজার শ্বশুড়মশাই তখনকার দিনে বাংলা সাহিত্যের এম.এ। দেশভাগের পর বাংলাদেশ ছেড়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এদেশে আসেন। সংসার চালানোর তাগিদে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। এখন সোদপুর স্টেশন রোডে দুটো শাড়ির দোকান। পূজার স্বামীকে সবাই অপুদা বলে ডাকে। হাসিখুশি মেজাজের দিলদরিয়া মানুষ এই অপুদা। একা হাতে পারিবারিক ব্যবসার সবটা সামলান।
পূজার নিজস্ব বুটিক শুরুর গল্প শুনছিলাম ওঁর ছয় বছরের মেয়ে দেবাত্রির স্কুল ক্যাম্পাসে বসে। মেয়েকে তিনি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করেছেন। পূজা বলছিলেন তিনি নিজে জীবনে যে যে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সেই সবকিছু দিয়েই মেয়েকে তৈরি করতে চান। মেয়েকে মানুষ করার জন্য রীতিমত লড়াই করছেন পূজা। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। আঠারো বছরের মেয়েটি তখন সবে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি টপকে কলেজে পড়তে চেয়েছিলেন। ডানা মেলে উড়তে চেয়েছিলেন স্বাবলম্বী আকাশে। কিন্তু জ্যামিতি বাক্স গুছাতে গুছাতেই সংসার গুছানো আয়ত্ত করতে বাধ্য হন এই মেয়ে। তাই ওড়া তাঁর হয়নি। বাবা বিয়ে ঠিক করে ফেলেন। অনেক কাঁদেন পূজা। তাঁর লেখাপড়ার সব ইচ্ছে সব আর্তি নাকচ হয়। আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের যা ভবিতব্য তাই হল। বিয়ে। সন্তান। সংসার। যৌথ পরিবারে পূজার শ্বশুড়, শাশুড়ি, খুড় শ্বশুড়, খুড় শাশুড়ি, ছোট দেওর। হাসিমুখে সবার খেয়াল রাখেন। ছোট্ট সন্তানের যত্নেই কাটে দিনরাত। সংসারের সব কাজের ফাঁকে মেয়েকে পড়ান পূজা। চান মেয়ের পড়ায় যেন কমতি না হয়। এরই ফাঁকে একটু একটু করে সামনের দিকে এগোচ্ছেন ব্যবসায়ী পরিবারের এই বধূ। নিজের পরিচয় তৈরি করতে, রোজগার করতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে ধনুকভাঙা পণ করেছেন। গত বছর দুর্গা পুজোর আগে তিনি একটি বুটিক খোলেন। সোদপুরের শেঠ কলোনিতে। ডিজাইনার শাড়ি ও সালোয়ার পাওয়া যায়। পূজার হৃদপিণ্ড যদি ওঁর সন্তান, তবে ফুসফুস চলে ব্যবসার অক্সিজেনে। বিয়ের পর থেকেই স্বামীকে শাড়ির ব্যবসায় সাহায্য করতেন। শাড়ি ও সালোয়ারের পিস ভর্তি ব্যাগ নিয়ে উৎসবের মরশুমে তিনি মেয়ের স্কুলে আসতেন। সঙ্গে জামাকাপড়ের ছবির ক্যাটালগও থাকত। বাচ্চাদের মায়েরা আর শিক্ষিকারা আগ্রহ ভরে দেখতেন। নানান ডিজাইনের শাড়ি, সালোয়ার। খুব ছোটো শুরু। ন্যায্য মূল্যে, সহজ কিস্তিতে কাস্টমারদের পোশাক বেচতে বেচতেই পূজার ব্যবসার পরিধি বাড়তে লাগল। মাত্র নব্বই হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। বছর ঘুরতেই পেরিয়ে গেছেন ব্রেক ইভেন। এখন ও রীতিমত সফল ব্যবসায়ী। দেবনাথ বস্ত্রালয়ের পরিচিতি আর খ্যাতি দুইই বেড়েছে পূজার দৌলতে। ডানা মেলেছে পূজার নিজস্ব বুটিক দেবাত্রীও।
সম্প্রতি ব্যাঙ্ক থেকে হোমলোন নিয়ে খড়দায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। মাসিক কিস্তি শোধ করছেন। মেয়ে দেবাত্রিকে অনেক দূর পড়াতে চান। যে কোনও মূল্যে ওর স্বপ্নকে সফল হতে দেবেন। রেজোলিউশন নিয়েছেন। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন। সেদিন স্কুলে একটা ভিজিটিং কার্ড আমার হাতে দিয়ে পূজা বললেন," আসবেন কিন্তু আমার বুটিকে। " আমি হেসে বলেছিলাম, "নিশ্চয়ই।"