গ্রামে গঞ্জে গোলকিপার খুঁজে বেড়ান বিশ্বজিৎ
দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলের একটি কলোসি পাড়া। নাম গান্ধী কলোনি। সেখানে দুটি বেড়ার ঘরে এগারো জনের একটি পরিবার। পরিবারের একজন রোজগেরে সদস্যের একটি ছোট দোকান। আর কিছু বলার হয়তো প্রয়োজন নেই সেই পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকটি দিন কীভাবে চলে। সেই এগারো জনের মধ্যে একজন বিশ্বজিৎ বিশ্বাস। আজ ৫৪ বছর বয়সে তিনি প্রতিষ্ঠিত। টালিগঞ্জ অগ্রগামীর গোলরক্ষক কোচ ও সহকারী কোচ। একই সঙ্গে ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্টে প্রতিষ্ঠিত এক কর্মী। বাংলার ফুটবলে স্বর্ণযুগ তখনও শেষ হয় নি। কৃশানু দে, বিকাশ পাঁজি, অতনু ভট্টাচার্য, বিদেশী চিমা ওকোরি- সাতের দশকের মানুষের উন্মাদনার যে অন্যতম বিষয় ছিল, সেই ফুটবলে বিশ্বজিৎ বিশ্বাসও একজন সদস্য। গোলরক্ষক ছিলেন। খেলেছেন জর্জ টেলিগ্রাফ, পোর্ট ট্রাস্টের হয়ে। খেলেছেন জুনিয়র ভারতীয় দলের হয়ে। অসংখ্যবার পরেছেন সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার জার্সি। ফুটবলার হিসাবে তারকাদের কক্ষপথে হয়তো নিজেকে নিয়ে যেতে পারেননি বিশ্বজিৎ। কিন্তু খেলা ছাড়ার পর সহজাত ভাবে কোচ হয়ে যাওয়ার পর বিশ্বজিৎ বিশ্বাস নিজেকে নিয়ে গেলেন ব্যতিক্রমী এক উচ্চতায়। এবং তাঁর সেই কাজ কিন্তু চলছে নিঃশব্দে, বিনা প্রচারে।
চাকরির ফাঁকে ফাঁকে নিয়ম করে বিশ্বজিৎ ঘুরে বেড়ান গ্রাম বাংলার মাঠে মাঠে। কয়েক বছর আগে এরকম ঘটনাও প্রায়ই ঘটেছে যে, ক্লাবের প্র্যাক্টিস শেষ হওয়ার পর (তখন বিশ্বজিৎ ছিলেন পোর্ট ট্রাস্টের গোল কোচ) দিন তিনেক বিশ্বজিতের কোন হদিশ পাওয়া যায় নি। তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন! ফিরে আসার পর দেখা গিয়েছে তাঁর সঙ্গে একটি বা দুটি সরল, কিন্তু দুর্দান্ত শারীরিক গঠনের ছেলে। বিশ্বজিৎ হয়তো চলে গিয়েছেন ঝাড়গ্রামে, বা লালগড়ের কোনও ক্লাবে। সেখানে দুদিন থেকে খুঁজে এনেছেন ভীষণ সম্ভবনাময় দুটি কিশোর ফুটবলারকে। তারা দু’জনই যে গোলরক্ষক হবে তার কোন মানে নেই। হয়তো একজন গোলরক্ষক। অন্যজন স্ট্রাইকার। এটা বিশ্বজিতের নেশা। আর নেশার প্রতিফলন? সেই গান্ধী কলোনিতেই একফালি মাঠে বিশ্বজিৎ গোল কিপিং শেখান। শিক্ষার্থীর সংখ্যা? একশো ছাপ্যে গিয়েছে! অধিকাংশ শিক্ষার্থী আসে জেলা থেকে। এত দারিদ্র্য তাদের যে, কলকাতায় আসা সম্ভবই হতো না। কিন্তু অন্নদাতা সেই বিশ্বজিৎ বিশ্বাস। নিজে যাদের খুঁজে আনছেন তারা তো আছেই। তাদের বাইরেও যে কিশোর ফুটবলাররা গ্রাম, জেলা থেকে আসছে তাদের জন্যও বিশ্বজিতের ভাঁড়ার শেষ হচ্ছে না! ছেলেদের তিনি নিয়মিত জার্সি, প্যান্ট, বুট- তার সঙ্গে ট্রেনে যাতায়াতের ভাড়া, সমস্ত কিছু দেন! বিশ্বজিৎ বললেন, “ ছোটবেলায় গল্ফ ক্লাবের মাঠে বড়রা খেলতেন, আমি পিছনে দাঁড়িয়ে দেখতাম। যেদিন ওদের গোলকিপার আসত না, আমি গোলকিপার হয়ে খেলে দিতাম। এভাবেই গোলকিপার হয়ে গিয়েছিলাম। বাবা বলে দিয়েছিলেন খেলা চালানোর খরচ জোগানোর মতো সাধ্য তাঁর নেই। আমাকে জোগাড় করতে হবে। তারপর থেকে শুরু করেছিলাম পাড়ায় পাড়ায় ‘আন্ডার হাইট’ টুর্নামেন্ট গুলোতে খেলতে”। ক্ষেপ ফুটবল খেলে একমাসে দুহাজার টাকাও রোজগার করেছিলেন বিশ্বজিৎ। কলকাতার ফুটবলের দুনিয়ায় তখন দুজনের দাপট। বিশ্বজিত বিশ্বাস এবং কিংবদন্তি কৃশানু দে। এবং বিশ্বজিতের লড়াই ও মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখে সেই সাতের দশক থেকেই ফুটবলের তারকারা বিশ্বজিতকে স্নেহ করেন। যেমন গান্ধী কলোনির মাঠে বিশ্বজিতের গোলকিপার তৈরির কারখানায় নিজে থেকে যোগ দিয়েছেন বাংলার আর এক কিংবদন্তি সুরজিত সেনগুপ্ত। আর বিশ্বজিৎ বলেন, “ সুরজিত দ্যা যোগ দেওয়ায় আমি ধন্য”। সঙ্গে যোগ করলেন, “আসলে যে পরিমাণ কষ্ট করে খেলেছি, এখন কোন সম্ভবনাময় ছেলেকে একই রকম কষ্ট করতে দেখলে মনে হয় ছেলেটা একটু আর্থিক সহয়তা পেলে খেলাটা চালিয়ে যেতে পারে”।
বিভিন্ন জেলার ফুটবল ক্যাম্পে আর্থিক সহায়তার অভ্যাস বিশ্বজিতের অনেকদিনের। যেমন, শ্যামনগরে সুব্রত ভট্টাচার্যের ক্যাম্প। সেখানে প্রত্যেক মাসেই প্রায় ষাট থেকে সত্তরটি ছেলের জন্য জার্সি, প্যান্ট আর বুট যায় বিশ্বজিৎ বিশ্বাসের তহবিল থেকে। কিংবদন্তি গোলরক্ষক সনৎ শেঠের কাছে ভেটারেন্স স্পোর্টস ক্লাবে গোলকিপিং শিখেছেন বিশ্বজিৎ। বললেন, “সনৎদা বলতেন নিজে যে স্তরেরই ফুটবলার হোস না কেন মাথায় রাখবি, যে ফুটবল এত কিছু দিল তাঁকে কিছু অন্তত ফেরত দিয়ে যাওয়ার”। সেই কথাগুলো বিশ্বজিতের মাথায় গেঁথে গিয়েছে। তাই হয়তো সমস্ত কথার ফাঁকে বিশ্বজিৎ বলে ওঠেন, “ফুটবলার হিসাবে তো বিরাট নাম ডাক হয় নি। তাই খেলা ছাড়ার পর থেকে সবসময় মনে হতো ফুটবলকে কি ভাবে ফেরত দেওয়া যায়। এই পথটাই বেছে নিয়েছি। যাতে ভবিষ্যতে অন্তত কিছু ফুটবলার বলবে বিশ্বজিৎদা আমার দুর্যোগের দিনে পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল”।
কিছু ফুটবলার নন। বিশ্বজিতের এই নিরলস এই চেষ্টার ফসল অনেক ফুটবলারের উঠে আসা। পোর্টট্রাস্টের কোচ থাকার সময় প্রশান্ত ভোরা, রাজনারায়ণ মুখ্যার্জির মতো ময়দানে বড় ক্লাবে খেলা গোলরক্ষক থেকে শুরু করে এখনকার প্রজন্মের প্রিয়ন্ত সিংহ, রাজু গাঙ্গুলির মতো ফুটবলার। তবু, বিশ্বজিতের মনে খিদে যায় নি। আসলে, তাঁর যে সিনিয়র ভারতীয় দলের জার্সি পরা হয় নি। বললেন, “একটা ছেলে যদি সিনিয়র ইন্ডিয়ার জার্সি পরে আমার ক্যাম্প থেকে তাহলেই আমার শান্তি। আমার অধরা স্বপ্নের পূরণ হবে”। তাই শুধু নিজের ক্যাম্প নয়, বিশ্বজিৎ আবার শুরু করেছেন জেলা ঘুরতে! মরসুম শেষ হওয়ার পরেই। ছেলে খুঁজে বার করতে। গোলরক্ষক তৈরি করা ও তাকে পালন করা যে নেশা!