পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ চিকিৎসায় সুজয়ের আইকিওরই ভরসা
এখনও গ্রামে গ্রামে ডাক্তার নেই। চিকিৎসার বন্দোবস্ত নেই। ওষুধ নেই। ম্যারাপ বেঁধে রাজনৈতিক আশ্বাসের মাইক আছে। আর অনন্ত হতাশা আছে। রাত বিরেতে অসুস্থ হলে দশ বারো মাইল এখনও ভ্যানে চড়ে যেতে হয় সরকারি হাসপাতাল। সেখানে আবার অন্য রকম নেই রাজ্য। এত সবের মধ্যেও এক বাঙালি যুবক একা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর অসীম সাহস আর উদ্যোম নিয়ে। তিনি সুজয় সাঁতরা। গ্রামের প্রত্যন্ত মানুষকে সুচিকিৎসা পৌঁছে দিতে খুলে ফেলেছেন তাঁর সংস্থা। আইকিওর।
আইকিওরের যাত্রা শুরু
খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুরের ঘটনা। সুজয়ের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হন। স্থানীয় ডাক্তার তাঁর চিকিৎসা করেন। অবস্থার উন্নতি হয়নি। তখন তাঁকে ব্যাঙ্গালোরে একটি কার্ডিওলজি ক্লিনিকে নিয়ে যান সুজয়। চিকিৎসক জানান তাঁকে ভুল ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রথম টনক নড়ে সুজয়ের। ভাবতে থাকেন কীভাবে এই হাঁতুড়ে চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আর এসব ভাবতে ভাবতেই তৈরি হয় আইকিওর।
উপায় টেলিমেডিসিন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে আইকিওর। পৌঁছে দেয় প্রয়োজনীয় ওষুধও। সুজয় চান খুব কম খরচে সহজলভ্য চিকিৎসা পান গ্রামের মানুষ। তাঁদের ক্লায়েন্ট ও বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশাও পূরণ করছেন তাঁরা।
শহর এবং গ্রাম। সাদা কালো ছবির মত। দ্বিধা বিভক্ত। একদিকে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা। অন্যদিকে নিদেন প্রাথমিক চিকিৎসারও চূড়ান্ত অভাব। ২০১৩ সালের কে.পি.এম.জি. র হেলথ রির্পোট বলছে দেশের সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থার মাত্র ৩০ শতাংশ পান গ্রামের মানুষ। ২০১২ সালের WHO এর ওয়ার্ল্ড হেলথ স্টাটিস্টিকস বলছে ভারতের মাত্র ৪৩.৫ শতাংশ গ্রামে ডাক্তার আছেন। সরকারী চেষ্টার পরেও গ্রামে পরিকাঠামোগত সমস্যা রয়েই গিয়েছে। চিকিৎসক নার্স এবং চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত পেশাদারের অভাব। রয়েছে পর্যাপ্ত ওষুধের অভাবও। এই নেই রাজ্যের দেশে সুজয়রা তাই ওয়্যারলেস হেল্থ ইনসিডেন্ট মনিটরিং সিস্টেমের সাহায্যে গ্রামের প্রত্যন্ত বাড়িটিতে সুচিকিৎসা পৌঁছতে চান। তাই সুজয় সাঁতরা প্রতিষ্ঠা করেছেন "আইকিওর"।
WHIMS ( ওয়্যারলেস হেল্থ ইনসিডেন্ট মনিটরিং সিস্টেম)
WHIMS হলো এমন এক সফ্টঅয়্যার, যার সাহায্যে চিকিৎসা হয় সেইসব রোগীদের যাঁদের বাসস্থানের কাছে হসপিটাল বা ক্লিনিক নেই। শহর ও গ্রামের যোগাযোগ মাধ্যম এই ক্লাউড বেস ওয়েব অ্যাপলিকেশন। এই ব্যবস্থার মারফত নজর রাখা হয় গ্রামে চিকিৎসারত ডাক্তার ও সেবকদলের ওপর।
এখানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চিকিৎসককে পরামর্শ দেওয়া হয়। ফলে মেডিকেল হিস্ট্রি রেকর্ড হয়ে যায়। সুজয় বলেন এই প্রয়াসের মাধ্যমে রোগীর রোগ ও রোগের কারণও সহজেই জানা যায়।
তাঁদের পরিষেবাকে আরও অত্যাধুনিক করতে চান সুজয়। সেবা দিতে চান প্রত্যন্ত গ্রামের নিরন্ন মানুষকেও। ২০১৬ সালে তাঁরা হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। এতে তাঁদের পরিষেবা আরও দ্রুততর হবে, এমনটাই আশা করেন তিনি।
গত কয়েক বছরে আইকিওর দলে পেয়েছেন পঞ্চাশ জন কর্মীকে। আছেন ডাক্তার,নার্স ও প্যারা মেডিকাল স্ট্যাফেরাও। ওঁরা সেবা দিচ্ছেন ২৪ ঘন্টা।
টেলিমেডিসিন ভারতে এখনও নতুন বিষয়। সুজয়ের মতে আইকিওরই একমাত্র সংস্থা যারা WHIMSএর সাহয্যে দূর সঞ্চালিত স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সম্ভব করতে পেরেছেন। এঁদের সঙ্গে আছেন উন্নতমানের সফটঅয়্যার ইঞ্জিনিয়র, চিকিৎসক, চিকিৎসাবিদ, হাসপাতাল পরিচালনকারীর দল এবং দক্ষ আইনজ্ঞ।
গ্রামে তাঁরা একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। খুব সুলভে গ্রামে টেলি মেডিসিন পরিসেবা দেন তাঁরা। খরচ মাত্র ১২০-১৫০ টাকা। শিক্ষার অভাব,পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির অভাব, এমন অনেক কঠিন বাধা অতিক্রম করেছেন সুজয়রা।
ভবিষ্যৎ বিস্তার
বীরভূম আর মেদিনীপুরেই তাঁদের সংস্থার ২৮টি আর.এইচ.সি হাব রয়েছে। তাঁরা আরো একশটি আর.এইচ.সি. এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পরতে চাইছেন আসাম, বিহার, ওড়িশা সহ পুরো পূর্ব ভারতে।
সুজয় বলছেন,"সেই মানুষটির কাছেই সাফল্যের স্বাদ উপভোগ্য, যিনি জীবনে ব্যর্থতার গ্লানিকে অনুভব করেছেন।" এই শিক্ষা তাঁকে কঠিন সময়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। মানুষের জীবনে লুকিয়ে থাকা সাহস ও সংকল্পই তাঁদের এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তাঁর বক্তব্য "সঙ্কটের কল্পনাতে হয়ো না মৃয়মান।"