ডিফেন্ডার অসীমের সীমাহীন লড়াইয়ের কাহিনি
ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডারের চোখ সব সময় সতর্ক থাকে। পেনাল্টির কাছাকাছি আসার আগেই মাঝ মাঠ থেকে বলটিকে নজর করতে হয় শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সেটিকে দেখে শূণ্যে উঠে বিপক্ষ দলের স্ট্রাইকারকে টপকে হেড করে বলটাকে বিপদমুক্ত করতে হয়। এ কাজে পা শরীর মাথা সব কিছুর সঙ্গে ভীষণ জরুরি দৃষ্টিশক্তির। আজ এমন এক ডিফেন্ডারের গল্প শোনাব সে জীবনের পেনাল্টি বক্স আগলে রাখতে ঘন্টার পর ঘন্টা বদ্ধ ঘরে বসে চশমা বানান। চোখের ওপর ষাট ওয়াটের আলো জ্বলে। ঘন্টার পর ঘন্টা তার নীচেই দ্রুত গতিতে ফ্রেমের মাপে কাচ ঘষেন। একের পর এক ফ্রেমে পরিয়ে দেন কাচ। দিনে কম করে চল্লিশটা চশমা বানিয়ে যেটুকু সময় পান ফুটবলকে দেন। লড়াকু এই ছেলেটির নাম অসীম দে। বাড়ি আলমবাজার। অলি গলি পাকস্থলির কোনও একটি প্রান্তে ঘাঁড় গুঁজে আসা ঘর। সংসার চালাতে গত আট বছর এভাবেই জীবনের সাথে সমঝোতা করে প্রেমের ফুটবল খেলছেন। গত পাঁচ বছর কলকাতা ফুটবলের প্রথম ডিভিশনে সাড়া জাগানো ডিফেন্ডার অসীম কে নিয়ে ময়দানের দারুণ গর্ব।
দু’বছর বি.এন.আরে খেলার পর গত দু’বছর ধরে অসীম খেলছেন এরিয়ানের হয়ে। বি.এন.আর থেকে এরিয়ানে যাওয়ার সময় অসীমের শৈশবের কোচ রঞ্জন ভট্টাচার্য এরিয়ানের অভিজ্ঞ কোচ রঘু নন্দীকে বলেছিলেন, “এই ছেলেকে নিলে আপনাকে আর বিদেশি ফুটবলার নিতে হবে না ডিফেন্সে।” প্রশংসা অসীমের কপালে আরও জুটেছে। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে খেলার পর লাল-হলুদের নাইজিরীয় স্ট্রাইকার চিডি এডে বলেছিলেন অসীমকে, “মাথা ঘুরে না গেলে তুমি অনেকদূর যাবে।” কিন্তু মাথা ঘুরবে কীভাবে? ওই অন্ধকার ঘরে বসে মাত্র ষাট ওয়াটের আলোর নীচে কাচ ঘষার সময় অসীমের মাথা ঝিম ঝিম করে। চোখ ঘুমে বুজে আসে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হয়।
দারিদ্র এমনই এক সর্বনাশা শব্দ যে অসীমের আর কিছু করার ছিল না। বাবা অশোক দে বেসরকারি একটা সংস্থায় কাজ করেন। অসীমের দাদাও। মা দীর্ঘদিন অসুস্থ। ২৪ বছর বয়সী ডিফেন্ডারের শারীরিক শক্তি আর মানসিক জোর দেখে মুগ্ধ হয়ে যান কোচেরা। সেই অসীম মা’র কথা বলতে গিয়ে ভিতরে ভিতরে ভেঙে যায়। সে বলে, “চশমার দোকানে কাচ ঘষার কাজ করে আমার দিনে একশো টাকা রোজগার হয়। মা’র ওষুধের জন্য প্রত্যেক মাসেই অনেক খরচ। আমি অন্তত একশো টাকা তো দিতে পারি।”
গতবছর কেরালায় বাংলার হয়ে জাতীয় গেমসে খেলতে গিয়েছিলেন অসীম। যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিলেন। ফিরে এসে কলকাতার প্রিমিয়ার লিগেও অসীমের ধারাবাহিকতা দেখার পরও এই মরসুমে সন্তোষ ট্রফির বাংলা দলে অসীমের ঠাঁই হয়নি। তাতেও ডিফেন্ডার নির্বিকার। বলল, “এখনও হয়তো নিজেকে নির্বাচকদের সামনে প্রমাণ করতে পারিনি”। এমনকি, ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান কর্তাদের মধ্যে অসীমকে নিয়ে আগ্রহ দেখার পরও পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি ডিফেন্ডার বলছে, “যখনই প্রশংসা শুনি তখনই মনে হয় এখনও তো কিছুই শিখি নি। সবে শুরু করলাম। আরও অনেক দূর যেতে হবে।” তাই মরশুম শেষ হলেও অসীমের পরিশ্রমে কোনও তফাৎ হয় না। ভোরে সে চলে যায় স্থানীয় ক্লাবের মাঠে। প্র্যাক্টিস করেন পাক্কা চার ঘন্টা। বাড়ি ফিরেই আবার চশমার দোকান।
অসীম স্বপ্ন দেখেন। গায়ে বড় ক্লাবের জার্সি। মায়ের জন্যে আর দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘিঞ্জি ঘর নয়, মা আরও আবাতাস পাবেন। অসীম আরও বড় আকাশ পাবে।