পেরেছেন বুধিরাম, ফিরেছেন ফুটবলে
উত্তর চব্বিশ পরগনার শ্যামনগর স্টেশন থেকে অটোতে প্রায় আধ ঘন্টার যাত্রা। বলতে হবে আদিবাসী পাড়া। কতবছর আগে ওই পাড়াটায় এসে জড়ো হয়েছিল ওড়িশার প্রত্যন্ত অঞ্চলের আদিবাসীরা কেউ বলতে পারে না। জানতে চাইলে সকলে বলে যান, তারা টুডুকে জিজ্ঞাসা করুন।
-তারা টুডু কে?
-বুধিরাম টুডুর বাবা।
কোনওরকমে দিন যেত। কয়েকবছর আগে পর্যন্ত। বছর চারেক আগে তারার বড় ছেলে শ্যামনগর পৌরসভায় কাজ পাওয়ার পর ঘরে দু’বেলা ভাত জোটে! সেই পরিবারেরই ছোট ছেলে বুধিরাম। শৈশব থেকেই তার নেশা শুধু ফুটবল। আর কিছুই জানে না। এমনকি আদিবাসী পাড়ায় একটু বড় হলেই যে কাজে লেগে পড়ার রীতি সেটাও ভেঙে গেল বুধিরামের ক্ষেত্রে। সে একটা ছেঁড়া ফাটা ফুটবল নিয়ে পাড়ার ছোট ছেলেদের সঙ্গে খেলে বেড়ায়। সেই ফুটবল যখন পুরো ছিঁড়ে গেল তখন তার পায়ে দেখা গেল রবারের একটা বল! আজ প্রায় পনেরো বছর পরও বুধিরামের মনে উজ্জ্বল সেই ছবি। বলছে, “ ফুটবল বাতিল হয়ে যাওয়ার পর আমার জ্বর এসে গিয়েছিল। এক সপ্তাহ বিছানায় শুয়েছিলাম। মা বলত, খেলতে পারছে না বলে জ্বর এসেছে!”
দাদার বন্ধুর হাত ধরে, বুধিরাম একদিন চলে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে। ভর্তি হয় অনূর্ধ্ব ১৫ দলে। সেটা ছিল ২০০৭। আদিবাসী সম্প্রদায়ের হওয়ার জন্য ছোট থেকেই বুধিরামের শারীরিক গঠন সুঠাম। কিন্তু ফুটবলার হতে গেলে তো পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন। বুধিরাম বলছে, “বাড়ি থেকে ছোলা আর আখের গুড় নিয়ে আসতাম। প্র্যাক্টিসের পর সেটা খেতাম। তারপর বাড়ি ফিরে ভাতের ফ্যান খেতাম নুন লঙ্কা দিয়ে!” তবু মাঠে বুধিরামকে থামানো যায় না! উইং হাফ হয়ে তার প্রান্তিক দৌড় দেখতে মাঠের ধারে লোক জড়ো হয়ে যায়। প্রচন্ড গতি, শটের তীব্রতা আর নিখুঁত নিশানায় মুগ্ধ হয়ে অনূর্ধ্ব ১৫ ইস্টবেঙ্গল দলের কোচ মনোজিৎ চন্দ বুধিরামকে পাঠিয়ে দেন অনূর্ধ্ব ১৯ ইস্টবেঙ্গলে। বুধিরাম বললেন, “সেদিন মনে হল ফুটবল খেলে ভবিষ্যৎ তৈরি করা যাবে।” অনূর্ধ্ব ১৯ ইস্টবেঙ্গলের কোচ প্রাক্তন তারকা তরুন দে। বুধিরামের গতিতে তিনিও মুগ্ধ। ততদিনে ক্লাব থেকে বুধিরামকে মাসে দু’হাজার টাকা বৃত্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অনূর্ধ্ব ১৯ ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলার সময়েই সন্তোষ ট্রফি খেলার জন্য বাংলা দলে নাম উঠে গেল বুধিরাম টুডুর। ২৪ বছর বয়েসের স্ট্রাইকারের এখনও মনে পড়ে সেই দিনের কথা। বললেন, আমি ভাবতে পারিনি ১৯ বছরের একটি ছেলে সিনিয়র বাংলা দলে সুযোগ পেয়ে যাবে।”
শ্যামনগরের আদিবাসী পাড়ায় সেদিন ছিল উৎসবের রাত! প্রত্যেকটি ঘরেই জ্বলে ছিল মশাল! আর বুধিরামের বাড়িতে? সেই প্রথমবার বুধিরামের বাড়িতে রাতে ভাতের সঙ্গে কাতলা মাছের কালিয়া! বুধিরাম বলছেন, “বিকেলেই দাদা খবরটা পেয়েছিল। তারপরই বাজার থেকে নিয়ে এসেছিল মাছ। কিন্তু ডিনার করার সময়েই মনে মনে ঠিক করেছিলাম সুযোগটার সদ্ব্যাবহার করতে হবে”। চার বছর আগের ঘটনা। গুয়াহাটিতে সন্তোষ ট্রফির আসর বসেছিল। বাংলার কোচ ছিল সাব্বির আলি। ফাইনালে বুধিরামের গোলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলা। তারপরেও টুডুর আফসোস যায় না। কেন? বুধিরাম বললেন, “সন্তোষ ট্রফি জিতে ফেরার পর আমাদের অই দলের সমস্ত ফুটবলারের চাকরি হয়ে গিয়েছিল। শুধু আমার হয় নি। কারণ আমি মাধ্যমিক পাস ছিলাম না।”
সেই ঘটনার পর থেকেই বুধিরামের ফুটবল দেবতা বোধহয় ওর ওপর থেকে চোখটা সরিয়ে নিয়েছিলেন। না হলে সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে গোল করে বাংলাকে জেতানো বুধিরামকে প্রায় একবছর ফুটবল থেকে দূরে চলে যেতে হবে কেন? গুয়াহাটি থেকে ফেরার পর ইস্টবেঙ্গলের সিনিয়র দলে উত্তোরণ হয় বুধিরামের। কিন্তু প্রথম একাদশে নিয়মিত সুযোগ পাচ্ছিলেন না। রিজার্ভ বেঞ্চে বসে সিনিয়র দলের তারকাদের দেখেই দিন কাটছিল। মনও ভেঙে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় ইউনাইটেড সিকিমে ‘লোনে’ চলে যায় বুধিরাম। আর সেখানে খেলতে গিয়েই হাঁটুতে চোট। চোটের এমনই গভীরতা যে অস্ত্রোপচার করাতে বাধ্য হন বুধিরাম। কলকাতায় অস্ত্রোপচার হয়। খরচ হয় দেড় লক্ষ টাকা! ময়দান থেকে দূরে চলে গেলেন বুধিরাম। ময়দানও ভুলে গেল সম্ভবনাময় স্ট্রাইকারকে। বুধিরাম হেসে বললেন, “টাকা দিয়ে সাহায্য করা দূরের কথা, কেউ ফোনও করত না। একমাত্র সৈকত সাহা রায় খোঁজ নিত। প্রায়ই বাড়িতে আসত।”
অনুপ্রেরণা দিলেন বন্ধু সৈকত
সৈকত সাহা রায়। ইস্টবেঙ্গলের জুনিয়র দলে বুধিরামেরই সতীর্থ। পরে লাল হলুদের সিনিয়র দলেও খেলেছেন। সেই সৈকত সাহা রায়ই ছিলেন একমাত্র ফুটবলার যিনি প্রায় রোজ বুধিরামকে দেখতে আসতেন। সে তখন যন্ত্রণার দিন। বিছানা থেকে নামতে পারতেন না বুধিরাম। বলছেন, “সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘরের চালে টালি গুনতাম! আর আমি তো পড়াশুনা জানি না। সৈকত এসে আমাকে শুধু বলত, কলকাতা ফুটবলে কোন কোন ফুটবলার গুরুতর চোট সারিয়েও দারুণভাবে ফিরে এসেছে। সৈকতের সেই উৎসাহে আমিও স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম যে, আমাকেও পারতে হবে।”
পেরেছেন বুধিরাম। ফিরেছেন ফুটবলে। হাঁটুর চোট সারিয়ে একবছর পর আবার ফুটবলের মূল স্রোতে ফিরেছেন তিনি। মহামডান স্পোটিং-এর হয়ে। গতবছর টালিগঞ্জ অগ্রগামীর হয়েও খেলেছেন তিনি। তাঁর স্বপ্ন দেখা এখনও জ্যান্ত। বলছিলেন, “সেদিন বলব সফল হয়েছি যেদিন বাবাকে বলতে পারব তোমাকে আর কাজে যেতে হবে না!”