এক ইঞ্চি চুলে ১৭৭ শব্দ লিখে বিশ্বরেকর্ড কুশলের
১৯৭৫ সালের সেই বইমেলার কথা আজও ভুলতে পারেন না কুশল দাস । একটা গোটা দিন, মেলায় গিয়ে বই না দেখে কুশল দাঁড়িয়ে রইলেন সেই লোকটার পাশে । লোকটা চালের উপর, একদানা মুসুর ডালের উপর যে কারও নাম লিখে দিচ্ছে । ভদ্রলোকের নাম যুগল কুন্ডু । সেই নামটাও ৩১ বছর পর মনে আছে কুশলের । থাকবে নাই বা কেন? গোটা দিন ধরে তাকে কম বিরক্ত করেননি কুশল । হাজার রকমের প্রশ্ন । কীভাবে লিখছেন, কি কি উপকরন ব্যাবহার করেন একদানা চাল বা ডালের উপর লেখার সময় । এরকম অনেক প্রশ্ন কুশল সারাদিন ধরে তাকে করেছিলেন । আর প্রত্যেকবার তাঁর প্রাপ্তি ছিল যুগল কুন্ডুর বিরক্তি । এখনও কুশলের মনে পড়ে । বললেন, “যতবার যা জিজ্ঞেস করেছি ততবার তাতে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন যুগলবাবু । কোন প্রশ্নেরই জবাব ভালভাবে দেন নি তিনি । অথবা আমার উৎসাহ দেখে কোন কাজও আমাকে দেখিয়েও দেননি ।”
কাজটার নাম মাইক্রোক্যালিগ্রাফি । ক্ষুদ্রতম বস্তুর উপর নিখুঁত ভাবে কোন কিছু লেখা । এটা একটা শিল্প । এরকম নয় এই শিল্পের ধ্বজ বাংলায় একমাত্র কুশল দাসের হাতেই উড়ছে । আরও কয়েকজন আছেন । যদিও সংখ্যাটা কম । কিন্তু কুশল ব্যাতিক্রমি হয়ে গেলেন একটা ক্ষেত্রে । তাঁর কাজ পৌঁছে গেল আন্তর্জাতিকতায় । মানুষের মাথার চুলের এক ইঞ্চি অংশে তিনি লিখে ফেলেছিলেন ১৭৭ টি শব্দ । সেই কাজ খোদাই হয়ে গেল লিমকা বুক রেকর্ডসে । সেই সংস্থা থেকে জানানো হয় কুশলের ওই বিরল কাজ বিশ্বরেকর্ড । কাজের গভীরতায় এবং পরিসংখ্যানের জোরে । সেটাও হয়ে গেল অনেক বছর । প্রায় ২২ বছর । তারপরেও কুশল আরও একটি কাজ করেছেন, যেটা তাকে পৌঁছে দিয়েছে অন্য এক উচ্চতায় । বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কুশল দুটি কাজ করেছেন শান্তিনিকেতন গিয়ে । মুসুর ডালের একটি দানার উপর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথ আর মুসুর ডালের একটি দানার উপর রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের একটি ছবি । কুশলের মাইক্রোক্যালিগ্রাফি সাড়া ফেলে দিয়েছিল শান্তিনিকেতনে ।
প্রায় ১০ বছর আগে করে আসা সেই কাজ নিয়ে এখনও নস্টালজিক ৪৯ বছর বয়সী কুশল । বললেন এখনও শান্তিনিকেতনে গেলে আমাকে ঘিরে ভিড় জমে যায় । বিশ্বভারতীর মিউসিয়ামে রাখা আছে আমার আঁকা ওই ছবি দুটো । প্রফেসররা দেখা হলেই বলেন, আমার ছবি দুটো দেখার জন্যই বেশি ভিড় হয় মিউসিয়ামে ।
কিন্তু মাইক্রোক্যালিগ্রাফি কীভাবে হল কুশলের নেশার বিষয়? জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর ২৪ পরগণার বেলঘরিয়া নামে একটি জায়গায় । স্থানীয় স্কুল দেশপ্রিয় বিদ্যানিকেতনে পরার সময় থেকেই কুশলের ঝোঁক ছবি আঁকার দিকে । আরও একটা গুন ছিল কুশলের, মুক্তোর মতো হাতের লেখা । কুশল কিছু লিখলে চট করে বোঝার উপায় নেই যে সেটা হাতে লেখা না ছাপা । এই প্রসঙ্গে লাজুক কুশলের স্বীকারোক্তি, “লেখাপড়ায় যে খুব ভাল ছিলাম তা নয় । তবু হাতের লেখা সেই ব্যার্থতা মাঝে মাঝে ঢেকেই দিত ।” পুরপুরিভাবে মাইক্রোক্যালিগ্রাফিতে ঢোকার আগে কুশল স্ক্রিপ্ট ক্যালিগ্রাফি করতেন, মাইক্রোক্যালিগ্রাফিও করতেন । সেই থেকে মাইক্রক্যালিগ্রাফির উপর কুশলের নেশাগ্রস্থ হওয়ার প্রেক্ষাপট ৩১ বছর আগের সেই বইমেলা । সেই যুগল কুন্ডু । সারাদিন ধরে যার প্রবল বিরক্তি আর অনিচ্ছা প্রকাশের হতাশা নিয়েই মাইক্রোক্যালিগ্রাফির প্রতি কুশলের প্রেম । তারপর চলল পড়াশুনায় নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া । মাইক্রোক্যালিগ্রাফির এনসাইক্লোপিডিয়া আছে । কুশল বলেছেন, “সেই নিয়ে সারাদিন পড়াশুনো করেছি । আর দিনের বেলায় করেছি চালের অথবা ডালের একটা দানা নিয়ে তার উপর লেখা আর ছবি আঁকা প্র্যাকটিস ।” কুশল বললেন প্র্যাকটিস কিন্তু সেটা আসলে সাধনা । সেই সাধনারই প্রতিফলন পরবর্তীকালে দেখা গিয়েছে কুশলের শৈল্পিক শ্রেষ্টত্বে । কিন্তু তারপরেও একটা আফসোস রয়ে যায় কুশলের মধ্যে । মাইক্রোক্যালিগ্রাফি স্বীকৃতি পেল না জনসাধারনের কাছে । আর্থিক ভাবে তো নয়ই । কুশল বলেছেন, “পরবর্তীকালে বইমেলায় আমি নিজে বসেছি টানা চৌদ্দ বছর । বিভিন্ন ধরনের মানুষ এসেছেন। মৌখিক প্রশংসা করেছেন কিন্তু কোন কাজের অর্ডার আসে নি । বিষয়টা ছবি আঁকার মতো হয়ে ওঠে নি । যে কারণে এর উপর কোন প্রদর্শনী হয় না ।” বইমেলার দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতা থেকেই কুশলের মধ্যে এই অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে । এমনকি মৌখিক প্রতিশ্রুতিও তিনি কম পাননি । নেদারল্যান্ডের এক মানুষ একবার তার কাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে সেখানে মাইক্রোক্যালিগ্রাফির প্রদর্শনীর আয়জন করে দেবেন বলেছিলেন । কিন্তু কুশল বলেছেন যে কেউ কথা রাখেননি । প্রত্যেকের দেওয়া মৌখিক আশ্বাস মুখ থেকে শুরু হয়ে মুখেই শেষ হয়ে গিয়েছে ।
কুশল বললেন, “আসলে আমরা যারা এই শিল্পের সাথে যুক্ত, তারাই পারিনি এই শিল্পকে ঠিকভাবে তুলে ধরতে, প্রচার করতে ।” তাহলে কি শুধু হতাশা কুশলের? না, পুরোটা তা নয় । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কুশলের চোখে আশার ঝলক । তিনি বলেছেন, “এই যে মাঝে মাঝে শান্তিনিকেতনে জাই, সেখানে গেলেই অনেক সাধারণ মানুষ আমার কাজ নিয়ে খুব উৎসাহিত । বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গনে গেলেও আমাকে অনেক মানুষ, ছাত্রছাত্রীরা বলেন কাজ দেখাতে । সম্প্রতি একবার ওখানে গিয়ে শুনলাম কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিজেই মাইক্রোক্যালিগ্রাফি করার চেষ্টা করছে ।” এটাই কুশলের কাছে আশার আলো । তিনি চেষ্টা করবেন ওই ছেলে মেয়েগুলোর মধ্যে দিয়ে এই বিরল শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার ।