বেলেঘাটার বাবুর টনিক সুব্রত ভট্টাচার্য আর শিব খেরা
উত্তর কলকাতার বেলেঘাটা। বাগজোলা খালের ধার দিয়ে তৈরি হওয়া অস্থায়ী বসতি। সেই বসতির মধ্যেই একটা ছোট্ট ঘর। দশ ফুট বাই দশ ফুট বললেও বেশি বলা হবে! সেখানেই থাকেন। ঘরটায় একটি খাট। সেই খাটই রাতে শোয়ার জন্য। সারাদিন সেটা ব্যবহৃত হয় বসার জন্য। মা, দিদা ছাড়া আর একজনও ওখানে বসতে পারে না। ঘরের একপাশে লাগানো একটি মই। বাইরের কোনও লোক এলে তার ওপরেই বসতে হয় বাবু মন্ডলকে।
বাবু মন্ডল। সদ্যসমাপ্ত সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার হয়ে খেলে আসা কলকাতা ময়দানের অন্যতম সম্ভাবনাময় ডিফেন্ডার। ফুটবলার হিসাবে তিনি কেমন? কিংবদন্তি ডিফেন্ডার সুব্রত ভট্টাচার্য তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “ভীষণ সম্ভবনাময়। পরিশ্রম করতে পারলে ভবিষ্যতে বাংলা একজন দক্ষ ডিফেন্ডার পাবে।” বাবুর বাবা বিশ্বনাথ মন্ডলের চায়ের দোকান। ঘরের সামনেই। কথা বলার সময় তাঁর চোখে হতাশা। বললেন, “ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি বাবুর এত ভালবাসা যে, বলতে পারিনি পড়াশুনা করে তাড়াতাড়ি একটা কাজে ঢুকে পড়। মনে আছে, বাড়ির সামনের রাস্তায় ছেলেদের সঙ্গে রবার বলে খেলার সময়ও বাবুকে কেউ টপকাতে পারত না। ছেলেগুলোকে বাবু বাজি রেখে বলত যে ওকে টপকাতে পারলে বাবার দোকান থেকে একটা বিস্কুট দেবে। আর রাতে আমাকে বলত, বাবা আজ কিন্তু তোমার দোকানের একটা বিস্কুটও খরচ হয়নি। সেই ছেলেকে কীভাবে বলব ফুটবল খেলিস না।”
বাবু মন্ডল অপরিসীম এই দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে পড়াশুনো চালিয়ে গিয়েছেন। চারু চন্দ্র কলেজে থেকে স্নাতক হয়েছেন। আর ফুটবল? ছোট থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল সুব্রত ভট্টাচার্যের মতো ফুটবলার হওয়া। সেই স্বপ্ন পূরণ হল দু’বছর আগে টালিগঞ্জ অগ্রগামীতে এসে। যে মরসুমে টালিগঞ্জ অগ্রগামী ৫৬ বছর পর কলকাতা প্রিমিয়ার লিগে দু’নম্বর হল, সে বছরও বাবু টালিগঞ্জ অগ্রগামীর অন্যতম ফুটবলার। এবং বাবুর জীবনে উপরি পাওনা তাঁর সুব্রত স্যারের কাছে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ পাওয়া। চব্বিশ বছর বয়সী ফুটবলার ছিলেন ইস্টবেঙ্গলেও। কিন্তু দু’বছর আগের স্মৃতি এখনও বাবুর মনে ভীষণ উজ্জ্বল। সুব্রত স্যারের কোচিং-এর প্রায় প্রত্যেকটি দিনের কথা তাঁর মনে আছে। বাবু বললেন, “টাকা পয়সা থাকত না সঙ্গে। বেলেঘাটা থেকে রবীন্দ্র সরোবরে প্র্যাক্টিসে যাওয়ার টাকাটা শুধু বাবার কাছে চাইতাম। আর টিফিন হিসাবে নিয়ে যেতাম ছোলা আর এক গ্লাস ভাতের ফ্যান! কিন্তু প্র্যাক্টিসের পর অল্প সময়ের জন্য হলেও সুব্রত স্যার আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন। বলতেন নিজের ফুটবল জীবনের শুরুর দিকে লড়াইয়ের কথা। তখনই আবার মানসিক ভাবে চাঙ্গা হয়ে যেতাম। মনে হতো, সুব্রত স্যারের লড়াইও আমার চেয়ে কিছু কম ছিল না। তাহলে আমি কেন পারব না?”
সেই লড়াই বাবুকে টালিগঞ্জ অগ্রগামী থেকে পৌঁছে দিয়েছিল ইস্টবেঙ্গলে। আর্থিক কষ্ট কি মিটেছিল তাতে? বাবু বলছেন, “কী করে বলি সেটা? এখনও আমরা ওই একটা ঘরেই থাকি। দু’জন অতিথি বেশি এসে গেলে আমাকে কাঠের মইয়ের উপর চেয়ার মনে করে বসতে হয়। আর এখনও বাবাকে শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কাকভোরে উঠতে হয় চায়ের দোকান খুলে উনুনে আগুন দেওয়ার জন্য।”
ইস্টবেঙ্গলও বাবুকে পুরো মরসুম দলে রাখেনি। কলকাতা প্রিমিয়ার লিগ শেষ হওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছে। যে কারণে তাঁর জীবনে আবার নেমে এসেছে দারিদ্রের করাল ছায়া। কিন্তু দমে যাওয়ার ছেলে তো তিনি নন। বললেন, “স্থানীয় ক্লাবের মাঠে প্রতি দিন প্র্যাক্টিস করি। বাড়ি ফিরে এসে ভাবি সুব্রত স্যারের কথাগুলো।” আরও একজন মানুষ বাবুকে প্রতি দিন শক্তি জুগিয়ে যান। তিনি শিব খেরা। বাবু বললেন, “শিব খেরার বই প্রত্যেক দিন পড়ি। বিশেষত ওই লাইনটা বার বার পড়ি, যেখানে তিনি লিখেছেন, ‘তুমি পারবে’।” সুব্রত ভট্টাচার্য আর শিব খেরা- দু’জনের অদৃশ্য আশীর্বাদ নিয়ে লড়াই চালাচ্ছেন বেলেঘাটার বাবু। তাই হয়তো তাঁর মুখে শোনা গেল স্বগতোক্তি, “ আমাকে থামানো যাবে না!”