ট্যাক্সিচালকের ছেলের ৩৮৩ রানের রেকর্ড, উল্লসিত মনোজ
ঋত্বিক সিংহ। ১৯ ফেব্রুয়ারী কলকাতার ক্রিকেট ইতিহাসের অজস্র কীর্তির দলিলে, নিজের নামটা লিখিয়ে ফেলল। বয়স মাত্র ১৫ বছর। স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে, মেয়রস কাপ চ্যাম্পিয়নশিপে তির্থপতি ইনস্টিটিউশনের হয়ে সে করেছে ১৬৬ বলে ৩৮৩ রান। কলকাতার স্কুল ক্রিকেটের ৪৫ বছরের ইতিহাসে প্রথমবার এরকম নজির। বাবা আশিষ সিংহ ভোরবেলা উঠেই মাঠে চলে গিয়েছিলেন ছেলের খেলা আছে জেনে। কিন্তু সেঞ্চুরি হওয়ার পরেই বাবাকে মাঠ ছাড়তে হয় । কারন তিনি ট্যাক্সি চালক, আর তাঁর ছেলে একশো রানে পৌঁছানোর পরেই তাঁর মনে হয়েছিল ছেলের জন্য একটা ভালমন্দ কিছু কিনে নিয়ে যেতে হবে বাড়িতে । তার জন্য ছেলের খেলা দেখা যাবে না, ট্যাক্সি চালিয়ে রোজগার করলে তবেই কিছু কিনে নিয়ে যাওয়া যাবে।
আশিষ সিংহ বলছেন, “ভাবতে পারিনি ছেলে এরকম একটা রেকর্ড করবে । দুবেলা ভালভাবে খাওয়াতেও পারি না। সে অবস্থায় ঋত্বিক এভাবে ব্যাট করবে ভাবতেও পারিনি।” ভাবতে পারার কথাও নয়। যে ব্যাট দিয়ে ঋত্বিক ৩৮৩ করল সেটাও স্কুলের এক বন্ধুর কাছে ধার করা। ত্রিশত রান করে আউট হওয়ার পর সেই ব্যাট ঋত্বিককে ফেরত দিতে হল। এমনকি, যে বুট টা পরে ঋত্বিক খেলছিল সেইটাও ওর নিজের নয় । আশিষ সিংহ বললেন, “কি করব, দুবেলা ঠিকমতো খেতেই দিতে পারি না আবার ক্রিকেটের সরঞ্জাম কীভাবে কিনে দেব?”
১৯ ফেব্রুয়ারি ৩৮৩ রানের নতুন কীর্তি স্থাপন করার পর ঋত্বিকের জীবনে হয়তো একটু রং এল। দক্ষিণ কলকাতার হাজরার বেনিয়াটোলা লেনের বস্তিতে বেড়ার দেওয়ালটা হয়তো এবার পাকা হবে । কারন কলকাতা কর্পোরেশন থেকে সেদিনের পরেই জানানো হয়েছে আর্থিকভাবে সাহায্যের কথা । দুই ছেলে আর স্ত্রিকে নিয়ে সংসারে অপরিসীম অভাব। অনটনের সংসারে ভাগ্যদেবতা হয়তো এবার মুখ তুলে চাইতে পারেন। এর সঙ্গে আরও একটি আকর্ষনীয় খবর রয়েছে। ঋত্বিকের ধুন্ধুমার ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বাংলার ক্রিকেট অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি। ৩৮৩ রানের ইনিংসে ঋত্বিক মেরেছে ২৬ টা ছয় এবং ৪৮ টা চার । মনোজ তিওয়ারি বলেন, “ওর পুরো ইনিংস টা দেখতে পাই নি, তবে যেটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়েছে ঋত্বিককে খেলাটা শেখাতে পারলে ও অনেকদূর যাবে।”
শুধু বলেই থামেননি মনোজ, ঋত্বিক কে নিজের সই করা একটা ব্যাটও উপহার দিয়ে দিয়েছেন। এই ব্যাট নিয়েই ১৫ বছরের ছেলেটা আগামি দিনে মাঠে নামবে। স্কুলের গেম টিচারও এগিয়ে এসেছেন একজোড়া বুট নিয়ে। ভাগ্যিস স্কুল ক্রিকেটে ইতিহাসটা গড়ল ঋত্বিক। আশিষ সিংহ বললেন, “ছোটবেলায় ঘরে একটা কাঠের স্কেল কে ব্যাট বানিয়ে আর জলের বোতলের ছিপিকে বলের মতো ব্যাবহার করত ঋত্বিক। ক্রিকেট ছিল ওর ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু কোন কোচিং ক্যাম্পে ভর্তি করতে পারিনি টাকার অভাবে।”
এই অবস্থায় ঋত্বিককে খেলা শেখাতে এগিয়ে আসেন, স্থানীয় এক ক্রিকেট মাস্টারমশাই তন্ময় দাস। কোনও টাকা পয়সা না নিয়ে সেই ভদ্রলোকই তৈরি করেন আজকের ঋত্বিককে। খুদে ব্যাটসম্যানের প্রিয় ব্যাটসম্যানের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাই হয়তো ঋত্বিক বলল, “আমার খুব ইচ্ছে সৌরভ স্যারের সাথে একবার দেখা করা, কীভাবে তিনি স্পিন বোলিংয়ের বিরুদ্ধে স্টেপ আউট করে ছয় মারতেন?”
এ তো গেল ঋত্বিকের ক্রিকেটীয় স্বপ্ন। কিন্তু এর বাইরেও ঋত্বিকের একটা স্বপ্ন আছে। মাত্র ১৫ বছরের একটা ছেলের মুখে এত পরিণত একটা স্বপ্নের কথা শুনে সত্যি অবাক হতে হয়। ঋত্বিক বলছে, “আমরা খুব গরিব। টালির চাল আর বেড়ার ঘরে থাকি। বাবাকে প্রত্যেকদিন কাকভোরে উঠে ট্যাক্সি নিয়ে বেরোতে হয়। জ্বর হলেও বাবা ঘরে বিশ্রাম নিতে পারেন না। আমার স্বপ্ন ক্রিকেট খেলে অনেক টাকা রোজগার করা। যাতে বাড়িটা পাকা হয়, আর বাবাকে যেন আর ট্যাক্সি চালাতে না হয়।”